আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

S M Ashraful Azom
0

আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে একটি স্মরণীয় ও কলঙ্কের দিন। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নিধনের মর্মন্তুদ স্মৃতিঘেরা বেদনাবিধুর দিন আজ। বাঙালির মেধা-মনন-মনীষা শক্তি হারানোর দিন আজ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, ঠিক সেই সময়ই রাতের আঁধারে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বেছে বেছে হত্যা করে। বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে এদিনে দেশকে মেধাশূন্য করার পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে ঘর থেকে তুলে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বাঙালি জাতির সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের বরেণ্য ও কৃতী সন্তানদের।
 
জাতির এসব উজ্জ্বল নক্ষত্র হত্যার মাধ্যমে হানাদাররা আমাদের মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল লড়াকু বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করলেও যেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু, দুর্বল ও দিক-নির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়লে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না— এমন নীল-নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই হায়েনারা বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল এই দিনে। স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ ৪৩ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে ইতিমধ্যে পাঁচজনের বিচারের রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
 
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিত্সক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতন চন্দ্র সিংহ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীন, সায়ীদুল হাসানসহ আরো অনেকে।
 
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্ম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলেই তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এদিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, যাঁরা ১৯৭১ সালে বিজয়ের প্রাক্কালে হানাদারবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত্ বরণ করেন। আমি তাঁদের পরিবারবর্গের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।’ তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার এবং সর্বকালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে দল-মত-নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিককে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতচক্রের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা রক্ষার অপচেষ্টা করছে তাদেরও একদিন বিচারের আওতায় আনা হবে। এসব রায় বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে।
 
তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ‘তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।’ বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জামায়াত ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ করে। শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতির বিজয়ের প্রাক্কালে তারা দেশের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিত্সক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, প্রকৌশলী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদসহ দেশের সেরা সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
 
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র এখন নির্বাসনে। ক্ষমতাসীনরা বিভেদের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দেশকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
 
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিবৃতিতে বেগম জিয়া বলেন, ১৪ ডিসেম্বর একটি বেদনাময় দিন, বাংলাদেশকে মেধা-মননে পঙ্গু করার হীন উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে হানাদার বাহিনীর দোসররা দেশের প্রথিতযশা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিত্সক, বিজ্ঞানীসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারা মনে করেছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই সদ্য স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশ মেধার উত্কর্ষহীনতায় নেতৃত্বহীন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে হীন উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। খালেদা জিয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।
 
জেপির শ্রদ্ধাঞ্জলি
 
জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে শহীদ বুদ্দিজীবী দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে জেপি নেতৃদ্বয় বলেন, মহান ও গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর আলশামস ও রাজাকার বাহিনী জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আজকের এই দিবসে আমরা তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসায় স্মরণ করছি। এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ জাতিকে আগামী দিনে দেশমাতৃকার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রেরণা জোগাবে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সেদিন যারা নিহত হয়েছিলেন তারা আমাদের জন্য দেশপ্রেম, আত্মোত্সর্গ ও আত্মত্যাগের সুমহান বাণী রেখে গেছেন। সকৃতজ্ঞ জাতি সেজন্য তাদের চিরকাল স্মরণ করবে। আমরা সেদিন যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের স্মরণ করছি।
 
কর্মসূচি
 
যথাযোগ্য ও শোকের আবহে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রভৃতি। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সকাল ৮টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। পরে ৮টা ৪০ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।
 
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয় ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের দলীয় সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে, ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ৯টা ১০ মিনিটে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকাল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ বক্তব্য রাখবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের ন্যায় সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশের সকল শাখা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
 
জেপির কর্মসূচি
 
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় পার্টির (জেপি) পক্ষ হতে আজ সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সাড়ে ৯টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top