টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল

S M Ashraful Azom
টানা ভারী বর্ষণে সারাদেশের নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বেড়েছে নদ-নদীর পানি। বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। কোথাও কোথাও বাঁধে ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। পানিতে ডুবে গেছে সবজি, ধানসহ ফসলি জমি। পুকুর ও ঘের ভেসে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে। অব্যাহত বর্ষণে সড়ক তলিয়ে গিয়ে গতকাল শনিবার বিকালে বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইত্তেফাক অফিস, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর:
 
বান্দরবান: বান্দরবান-কেরানীহাট প্রধান সড়কের পশ্চিম বরদুয়ারাসহ কয়েকটি স্থানে সড়কে প্রায় সাড়ে চার ফুট পানি জমে যাওয়ায় গতকাল বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ডুবে যাওয়া বাজালিয়া সড়কে নৌকা, রিকশা ও ভ্যানে করে লোকজন পারাপার হচ্ছে।
 
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ জালু জানান, বৃষ্টিতে সড়কে পানি জমে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বান্দরবানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। বাজালিয়ায় ঘরবাড়ি এবং মত্স্য খামার পানিতে ডুবে গেছে। অপরদিকে টানা বর্ষণে বান্দরবান সদরের মেম্বারপাড়া, শেরেবাংলা নগর, আর্মিপাড়া, ওয়াবদাব্রিজসহ আশপাশের নিম্নাঞ্চলের কয়েক শতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বান্দরবানের সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
 
পৌর মেয়র মোহাম্মদ জাবেদ রেজা জানান, অব্যাহত বর্ষণে বান্দরবানে পৌর শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাজালিয়ার বড়দুয়ারা এলাকায় সড়কে পানি জমে যাওয়ায় বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কায় ঝুকিপুর্ণ বসতি ছেড়ে লোকজনদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
 
গতকাল বান্দরবানে ১৭৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর গত তিনদিনে প্রায় ৩০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবানের মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান।
 
চট্টগ্রাম অফিস: টানা বর্ষণে পাহাড় ও উঁচু এলাকা থেকে নেমে আসা পানি নালা-নর্দমা খাল উপচে গতকালও প্লাবিত করেছে নগরীর পঞ্চাশটি নিম্নাঞ্চল। ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও খেলার মাঠ পানিতে ডুবে গেলে জনভোগান্তি চরমে উঠে। দুপুরের পর বৃষ্টির তীব্রতা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় এক পশলা প্রবল বর্ষণে মেহেদীবাগ, মুরাদপুর, কাপাসগোলা, নাসিরাবাদ ও আগ্রাবাদের বিভিন্ন এলাকা ব্যাপকভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। যানবাহন চলাচল স্তিমিত হয়ে পড়ায় ঘরমুখো চাকরিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বৃষ্টির মধ্যে ঘরে ফিরতে বিড়ম্বনায় পড়ে। ঈদের ছুটি শেষ ঘরফেরা মানুষও নানা স্থানে আটকা পড়ে। নগরীর আগ্রাবাদে এবারের বর্ষা মৌসুমে জোয়ার ও বৃষ্টির পানির তোড়ে জলমগ্নতার সমস্যা প্রকট আকার নিয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অফিস বর্ষণ অব্যাহত থাকার সম্ভাবনার কথা বলছে।
 
চকরিয়া (কক্সবাজার): মাতামুহুরী নদীর পানির প্রবল চাপে ভেঙ্গে গেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা জেটি (রাবার ড্যাম) সড়কের আড়াইশত মিটার বেড়িবাঁধ। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে নদীর পানি। অন্তত ১৫ হাজার বাসিন্দা  পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।  মেরামত করা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার খবর পেয়ে তাত্ক্ষণিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চকরিয়া উপজেলা  নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম।
 
        উপজেলার চিরিঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন ও ইউপি মেম্বার আলী আহমদ বলেন, গত জুন মাসের শেষ দিকে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় চিরিঙ্গা ইউনিয়নের ওই এলাকার বিশাল আয়তনের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াছের নির্দেশে বিশেষ বরাদ্ধের আওতায় কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড চলতি মাসে ক্ষতিগ্রস্থ ওই এলাকার বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ শুরু করে। তাঁরা বলেন, প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় করে বালি বস্তা ফেলে ও মাটি দিয়ে ইতিমধ্যে বােঁধর বেশিরভাগ অংশ জোড়া লাগানো হয়েছে। এ অবস্থায় গত দুইদিনের টানা ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানি নামলে এর প্রচন্ড চাপে সর্বশেষ শনিবার দুপুরে ফের আড়াই শত মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নদীতে তলিয়ে গেছে।
 
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া শাখা কর্মকর্তা (এসও) মোহাম্মদ আলী বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগরঘোনা পালাকাটা জেটি পয়েন্টের ওই বেড়িবাঁধের মেরামত কাজ চলছে জরুরী প্রকল্পের আওতায়। এখনো বাঁধের পুরো কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় ভারী বর্ষণে নদীর পানি প্রবল চাপে শনিবার দুপুরে নির্মাণাধীণ আড়াইশত মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। তিনি বলেন, বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে জানানো হয়েছে। 
 
      জানতে চাইলে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, স্থানীয় জনগনের স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত সময়ে ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারে নির্দেশ দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে তারা ইতিমধ্যে সংস্কার কাজও প্রায় সমাপ্ত করেছেন। কিন্তু শনিবার দুপুরে ভারী বর্ষণের কারনে ওই এলাকার বেড়িবাঁধের একটি অংশ ভেঙ্গে গেছে। তিনি বলেন, এখানে স্থায়ীভাবে আরসিসি ব্লকদ্বারা টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
 
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম): পানি থৈ থৈ করছে উপজেলার হাশিমপুর বড় পাড়া, জামিজুরী, বরকল, বরমা, সাতবাড়িয়া, যতরকুল, দোহাজারী, খাগরিয়া, ফতেনগর, জোয়ারা, কঞ্চনাবাদ ও ধোপাছড়ি এলাকায় । পানির নিচে তলিয়ে গেছে আউশ ও সবজি ক্ষেত এবং মত্স্য খামার।  শঙ্খ নদীর পানি বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী, হাশিমপুর, বড়পাড়া, গাছবাড়িয়া, বাদমতল এলাকায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
 
জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা): টানা ভারী বর্ষণ ও উজানের পানিতে উপজেলার ১ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমির ধান ক্ষেত ও ৫৫০ হেক্টর জমির সবজি ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার প্রায় ছোট-বড় ১শ’ টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।                             
 
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে বাঁশখালীর উপজেলার বির্স্তীণ গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ছোট-বড় ১২টি পাহাড়ি ছরার ( ঝর্ণা ) পার ভেঙ্গে এবং পাহাড়ি ঢল হু হু করে ঢুকে অন্তত ৪২টি গ্রামে দুর্ভোগ নেমেছে। অধিকাংশ এলাকা হাঁটু থেকে কোমড় পানিতে ডুবে থাকায় রান্না-বান্নার কাজও বন্ধ রয়েছে। ২ শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি আংশিক ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে, শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
 
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ আহমদ খান বলেন, ‘ পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে উপজেলা পরিষদ ভবন, স্টাফ কোয়ার্টারেও পানি ঢুকে গেছে। বির্স্তীণ গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্থদের নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’
 
ফেনী: মুহুরী ও কহুয়া নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ফুলগাজীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফুলগাজী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মফিজুর রহমান জানান, ফুলগাজীর মুহুরী নদীর সাহাপুর ও উত্তর দৌলতপুর এলাকায় দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে কহুয়া নদীর বৈরাগপুর এলাকার একটি স্থানে বাঁধ ভেঙে তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
 
কেশবপুর (যশোর) : কপোতাক্ষের বন্যা রক্ষা বাঁধ উপচে পানি গ্রামে প্রবেশ করছে। হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধটি। যে কোন মুহুর্তে বাঁধের একাধিক স্থান ধসে পড়তে পারে। শুক্র ও শনিবারের বিরামহীন বৃষ্টিতে কেশবপুরে নতুন করে আরও ২০ গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। উপজেলার সিংহভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের খাল অবৈধ দখলমুক্ত না হওয়ায় পানি বের হতে পারছে না। এ কারণে সাধারণ মানুষকে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবণ যাপন করতে হচ্ছে। 
 
সেনবাগ (নোয়াখালী): টানা ভারী বৃষ্টিপাতে সেনবাগ উপজেলা ও পৌরসভার নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বহু মত্স্য খামারের লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। অনেক বাড়ি-ঘরে পানি উঠায় মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলার বাতাকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, কানকিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এনায়েতপুর মাদ্রাসাসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গতকাল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। টানা ভারী বৃষ্টিপাত ও সরকারি খালে বাঁধ ও দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকলে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে।
 
ওসমানীনগর (সিলেট) : গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সিলেটের বালাগঞ্জ এবং  ওসমানীনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। দুই উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়নের প্রায় ২ শতাধিক গ্রাম জলাবদ্ধতার শিকার। গ্রামের বাসিন্দারা পানির কারণে কেউ গৃহহারা, আবার কেউ নিজ ঘরেই পানিবন্দি। গো-খাদ্যের সংকটে গবাদিপশু নিয়ে তারা পড়েছে মহাবিপাকে। প্রায় অধিকাংশ এলাকার আউশ ও রোপা আমন ফসল পানির নিচে ডুবে গেছে। দুই উপজেলার অধিকাংশ সড়ক এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে।  হাওর গুলিতে পানিতে থৈ থৈ করছে। বন্যায় কবলিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকারি বরাদ্দ নিজের পকেট ভরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম করেন। আর এর ফল আমরা ভোগ করি।
ট্যাগস

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top