সত্যালোকের সন্ধানে : রমজান মাস, তাকওয়ার মাস

S M Ashraful Azom
রমজান মাস। তাকওয়ার মাস। আত্মশুদ্ধির মাস। লাইলাতুল কদরের মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস। জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসে রোজা পালন করা মুসলমানের উপর ফরজ। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদার গণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতীদের ওপর। যাতে তোমরা খোদা ভীরু ও সংযমী হও’। অথাৎ পূর্ববতী সব নবী ও রাসূল (সা.)-এর ওপর সিয়াম বা রোজা পালন করা ফরজ ছিল। রোজা ফরজ করার  উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা মুত্তাকীর গুণ অর্জন করা। রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল করেছেন। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘রমজান মাস হলো সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নিদেশ। আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পাথক্য কারী’। আল কোরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য একটি জীবন বিধান। এই সংবিধানে রোজার বিশেষ গুরুত্ব, সম্মান ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া রোজা একটা কষ্টকর এবাদত। এই কষ্টকর ইবাদতটি ধনী, গরিব সবাইকে পালন করতে হয়। যাক সে সব কথা। আজকের আলোচ্য বিষয় হলো ‘রমজান মাস, তাকওয়ার মাস’। আমরা কিভাবে তাকওয়া অর্জন  করে মুত্তাকিন বান্দা হব। তাকওয়া কি? আসলে কি রমজান মাসে রোজা পালন করলেই তাকওয়ার গুণ  অর্জন সম্ভব? তাকওয়াই হচ্ছে রমজান মাসের সার বস্ত বা আসল কথা। হজরত উমর (রা.) কা’ব আল আহবাররাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাকওয়া কি? উত্তরে কাব (রা.) জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি কখনো কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন? তখন আপনি কী পন্থা অবলম্বন করেন? হযরত উমর (রা.) বলেন, সতর্ক হয়ে কাপড় গুটিয়ে চলেছি। কাব (রা.) বলেন, ‘এটাই তাকওয়া’। মনে প্রাণে আল্লাহকে ভয় করাকে তাকওয়া বলে। পৃথিবীতে যতগুলো ধর্মানুসারী রয়েছে, তার মধ্যে ইসলাম ধর্ম একটি শান্তির ধর্ম, নৈতিকর্তার ধর্ম।  নৈতিকতায় তৃতীয় স্তর হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ার অর্থ কেবল ভয় ভীতি নয়, তাকওয়া অর্থ পরহেজগারিতা। পরিভাষায় তাকওয়া হলো, আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও অপছন্দনীয় চিন্তা, কথা ও কাজ-কর্ম থেকে আত্মরক্ষার মনোভাবকে তাকওয়া বলে। এরশাদ হচ্ছে- ‘হে ইমানদার গণ! আল্লাহকে ভয় কর, যেমন ভয় করা উচিৎ এবং আত্ম সমর্পণকারী হওয়া ব্যতীত মৃত্যুবরণ করো না’। মানুষ প্রতিনিয়ত, অনেক পরিকল্পনা করে থাকে। আল্লাহ তাআলা মানুষের মনের গোপন সব খবর রাখেন এবং জানেন। এরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মনের সব বিষয় সম্পর্কে খবর রাখেন’। অন্য জায়গায় বলেছেন-‘আল্লাহকে ভয কর এবং জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়েই জানেন’। মানুষের চাহিদা অনেক। সব চাহিদা ও রিজিক আল্লাহ পূরণ করেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য চলার পথ বের করে দেন এবং রিজিকের ব্যবস্থা এমনভাবে করেন যা সে কল্পনা করতে পারেন না’। যাদের মাঝে খোদা ভীতি বা তাকওয়া রয়েছে তার জন্য প্রতিটি কাজ করা অতি সহজ। এরশাদ হচ্ছে-‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন’। রমজান মাসের সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ বৃদ্ধি করেছেন।  এ মাসে সব  আসমানি কিতাব ও সহিফাসমূহ নাজিল করেছেন। হযরত আবু যর  গেফারী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত রাসূল  (সা.) বলেছেন, হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর উপর সহিফাসমূহ ৩রা রমজানে, তাওরাত ৬ রমজানে, ইনজিল ১৩ রমজানে এবং যবুর ১৮ রমজানে আবতীর্ণ হয়েছে। আসমানি কিতাব মহাগ্রন্থ আল কোরআন রমজান মাসের চব্বিশ তারিখে বায়তুল ইজ্জতে একত্রে নাজিল হয়েছে (মাযহারী)। এরশাদ হচ্ছে ‘নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে (কদর)। তিনি আরো বলেন, ‘আমি তো এ কোরআন অবতীর্ণ করেছি এক মোবারক রাতে’ (দুখান)। এখানে রমজান শব্দটি রমজ ধাতু থেকে এসেছে। অর্থ দহন বা পোড়ানো।  রোজা ফার্সি শব্দ। অথর্- উপবাস। আবার রোজার আরবি শব্দ হচ্ছে সাউম। সাউমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় সোবহি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাউম’। রমজান মাস রহমত, বরকত এবং মাগফিরাতের মাস। রমজান মাসে সুদ ঘুষ, মদ জুয়া, চুরি ডাকাতি, জেনা ব্যভিচার, হিংসা বিদ্বেষ, হানা হানি, মারা মারি, আত্ম অহংকারসহ সব কিছু ভুলে এক মাত্র সিয়াম সাধনা করে, তাকওয়া বা খোদা ভীতি গুণ অর্জন করি। তাকওয়া বা মুত্তাকির গুণ অর্জনের জন্য এ মাস হচ্ছে আনন্দের। বান্দার আনন্দ হচ্ছে রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। ‘বিশ্ব নবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি অতি আনন্দদায়ক সময়, একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি আল্লাহর দিদারের সময়’। ‘হাদিসে কুরসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন- ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব’।রমজান মাস সম্পর্কে ‘হজরত রাসূল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস আগমন করে তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শেকল পরানো হয়’। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সাথে একনিষ্ঠ সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে তার পেছনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’। হযরত রাসূল (সা.) বলেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ। যদি তোমাকে কেহ গালি দেয় অথবা আঘাত করে, তবে বলবে ভাই আমি রোজা রেখেছি।’ তিনি আরো বলেন- ‘দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুম্মা থেকে আরেক জুম্মা, এক রমজান থেকে আরেক রমজান এদের মধ্যকার সব গুনাহ মুছে ফেলে। যদি কোন ব্যক্তি কবিরাহ গুনাহ থেকে বিরত থাকে, তার জীবনের সব গুনাহ ক্ষমাহ করা হবে।’ হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন- হে লোক সকল, তোমাদের ছায়া দান করতে যাচ্ছে একটি মহান মাস, একটি মোবারক মাস। এ মাসে এমন একটি মহান রাত রয়েছে, যে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ এ মাসের সিয়ামকে ফরজ এবং কিয়ামকে নফল করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল  কাজ করবে সে অন্য মাসে একটি ফরজ কাজ করার সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ কাজ করবে সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ কাজের সওয়াব পাবে। মাসটি হল ধৈর্যের মাস। যার পরিণতি হলো জান্নাত। এ মাস হলো সহমর্মিতার। এ মাস এমন মাস যাতে মোমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। তিনি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধিনস্তদের বোঝা হালকা করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমাহ করে দেবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন’। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, হযরত রাসূল (সা.) বলেন- আমার উম্মতকে রমজান মাসে পাঁচটি বিশেষ গুণ দান করা হয়েছে, যা তাদের আগে কাউকে দেয়া হয়নি। যথা- ১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লহর কাছে মিশকের চেয়ে উত্তম। ২. ইফতর না করা পর্যন্ত ফিরিস্তারা তাদের জন্য দোয়া করতে থাকবে। ৩. রোজাদারের জন্য প্রতিদিন আল্লাহ জান্নাতকে সৌন্দর্য ম-িত করেন এবং বলেন, আমার নেক বান্দাহগণ দুখকষ্ট সহ্য করে অচিরেই এখানে পৌঁছবে। ৪. অবাধ্য শয়তানকে  এ মাসে বন্দি করে রাখা হয় বলে অন্য মাসের মতো এ মাসে তারা পাপকাজ সংঘটিত করতে পারেন না। ৫. রমজান মাসের শেষ রজনিতে  তাদের ক্ষমাহ করে দেয়া হয়। রাসূল (সা.)কে বলা হয়, তা কি লায়লাতুল কদর? জবাবে তিনি বলেন- না, বরং শ্রমিক তার কাজ পূর্ণ করলেই তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হয়।” তিনি আরো বলেন, ‘রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশক অপেক্ষা অধিক উত্তম। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কেহ একটি রোজা রাখিবে, তিনি তাকে দোজখের অগ্নি হতে সত্তর বৎসরের রাস্তা দূরে রাখবেন। ‘রোজাদার পরনিন্দা হতে বিরত থাকলে সমস্ত দিবসই  তার এবাদত রুপে গণ্য হবে। হালাল বস্তুর দ্বারা ইফতার করত ঐ সময় দোয়া করলে রোজাদারের দোয়া আল্লাহর দরবারের কবুল হয়। যে রোজাদার ব্যক্তি মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করতে পারে নাই  খোদা তার রোজার প্রতি রাজি নয়। পরিশেষে বলতে চাই, আমরা রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করতে পারি। যার মাঝে তাকওয়া আছে, সেই মুত্তাকিন। আমরা প্রতি বছর এক মাস রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া গুণটি অর্জনের চেষ্ট করে থাকি। আল্লাহর বিধি বিধান পালনে তার সন্তুষ্টি অজনের চেষ্টা করি। রোজা শিক্ষা, নৈতিক প্রশিক্ষণই শুধু নয় বরং সেই সঙ্গে কোরআনের মত বিরাট নিয়ামতের শোকর আদায় করতে পারি। এ জন্য রমজান মাসকে তাকওয়ার মাস বলি। তাই আসুন, আমরা সবাই দিনে রোজা পালন করি এবং রাতে কোরআন তেলাওয়াত করি। 
ট্যাগস

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top