প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা

S M Ashraful Azom
শিল্প-সংস্কৃতির নগরী বলতে এক মুহূর্তেই মনে আসে ফ্রান্সের প্যারিসের নাম। সেই প্যারিস রক্তাক্ত হলো আইএসের হামলায়। শতাধিক মানুষের রক্তে রঞ্জিত প্যারিসের প্রতি সমবেদনা জানাতে এবং নানা ধরনের সহায়তা করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এগিয়ে এসেছিল দ্রুতই। প্যারিসের হামলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর তত্পরতার কথা জানাচ্ছেন তরিকুর রহমান সজীব
 
গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত নয়টার পর ফ্রান্সের প্যারিসে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন স্থান আক্রান্ত হয় আইএস কর্তৃক। স্টেডিয়াম, থিয়েটার, রেস্তোঁরার মতো সব জনবহুল স্থানে এসব হামলায় নিমেষের মধ্যেই প্রাণ হারায় ১২৯ জন। অতর্কিত এই হামলার খবরে ফ্রান্স তো বটেই, গোটা বিশ্বই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। গোটা বিশ্বজুড়ে একদিকে ওঠে নিন্দার ঝড়, অন্যদিকে প্যারিসের ঘটনায় সমব্যাথী হয় বিশ্ব। আর প্যারিসের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যেন বিশ্বজুড়ে উন্মুক্ত একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রামে লাখো পোস্টের মাধ্যমে যেন বিশ্ববাসী সুযোগ পায় ফ্রান্সের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনের। ফেসবুক নিজেও ‘সেফটি চেক’ ফিচারের মাধ্যমে সুযোগ করে দেয় বিশ্ববাসীকে ফ্রান্সের পাশে দাঁড়ানোর; ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিকে সাময়িকভাবে ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙানোর মাধ্যমে সুযোগ করে দেয় ফ্রান্সের প্রতি সমর্থন প্রকাশের। ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও এসব সুযোগ গ্রহণের পাশাপাশি নানা ধরনের হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে জানান দেন নিজেদের সমর্থন।
 
প্যারিসে হামলার ঘটনার খবর চাউর হওয়ার পরপরই ফেসবুক তাদের ওয়েবসাইটে চালু করে ‘সেফটি চেক’ নামের বিশেষ ফিচার। প্যারিসে বসবাসরত কিংবা প্যারিসে সফররত যে কেউ এই ফিচারটি ব্যবহার করে ফেসবুকে থাকা বন্ধুদের কাছে জানিয়ে দিতে পেরেছেন নিজের নিরাপদে থাকার তথ্য। এখন ফেসবুক যেভাবে বিশ্ববাসীর প্রতি মুহূর্তের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে, তাতে করে এই ফিচারটি প্যারিসে থাকা লাখো মানুষের নিরাপদে থাকার খবর পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে তাদের স্বজনদের কাছে। শুক্রবার রাতেই এই ফিচারটিকে চালু করার জন্য ফেসবুক প্রধান মার্ক জুকারবার্গকেও প্রশংসা জানিয়েছে বিশ্ববাসী। এই ফিচারটি চালু করা প্রসঙ্গে জুকারবার্গ তার ফেসবুক পেজে লিখেন, ‘আজকের এই রাতে যারা প্যারিসে রয়েছেন, তাদের সকলের সাথে আমি একাত্ম বোধ করছি। এই ধরনের নৃশংস ঘটনার স্থান বিশ্বের কোনো দেশের কোনো শহরেই নেই। আমরা সেফটি চেক ফিচারটি চালু করেছি যাতে করে প্যারিসে থাকা যে কেউ তার স্বজনদের কাছে নিজেদের নিরাপদে থাকার খবরটি পৌঁছে দিতে পারে কিংবা ফেসবুকে থাকা যে কেউ তার স্বজন প্যারিসে নিরাপদে রয়েছেন কি না তা সহজেই জেনে নিতে পারে।’
 
ঘটনার পরদিন আরও একধাপ এগিয়ে ফ্রান্সের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন প্রকাশের সুযোগ করে দিতে ফেসবুক প্রত্যেক ফেসবুক ব্যবহারকারীকেই সুযোগ করে দেয় নিজেদের প্রোফাইল ছবির ওপর ফ্রান্সের পতাকা ব্যবহার করে সাময়িক একটি প্রোফাইল ছবি যুক্ত করার। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকা এই ফিচারটিকে লুফে নিয়েছে বিশ্ববাসী। শনিবার ফেসবুকে প্রবেশ করলেই দেখা গেছে অনেক মানুষের প্রোফাইল ছবির ওপরেই ফ্রান্সের পতাকার লাল, সাদা ও নীল রঙের প্রলেপ। এক ক্লিকেই ফ্রান্সের প্রতি সমর্থন জানানোর এই সুযোগের প্রশংসাও করেছেন সকলেই। এই ফিচারটি ব্যবহার করে যারা ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন তাদের প্রোফাইল ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘ফ্রান্স ও প্যারিসের মানুষদের সমর্থন করতে আপনার প্রোফাইল ছবিটি বদলে দিন।’ জুকারবার্গ নিজেও নিজের প্রোফাইল ছবিটি বদলে নিয়েছেন ফ্রান্সের পতাকার রঙে।
 
প্রোফাইল ছবি বদলে দেওয়া ছাড়াও শুক্র ও শনিবারের ফেসবুকে লাখো মানুষের পোস্টে ছড়িয়ে ছিল প্যারিসের হামলা নিয়ে নিজেদের বক্তব্য। আর এসব স্ট্যাটাসের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ে #PrayForParis হ্যাশট্যাগ।
 
ফেসবুকের মতো টুইটারেও ব্যবহারকারীরা প্যারিস ও ফ্রান্সের প্রতি সমর্থন ও সমবেদনা প্রকাশ করতে ব্যবহার শুরু করে বেশ কয়েকটি হ্যাশট্যাগ। এর মধ্যে শুরুতেই ভাইরাল হয়ে যায় #PorteOuverte হ্যাশট্যাগটি, যার অর্থ ‘খোলা দরজা’। প্যারিসের হামলায় যারা আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিংবা প্যারিসে আশ্রয়ের খোঁজে রয়েছেন, এমন যে কাউকে আশ্রয় দিতেই প্যারিসের মানুষ এই হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করেছেন। তারা এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে জানাতে চেয়েছেন যে তাদের দরজা আশ্রয়প্রার্থী সকলের জন্য উন্মুক্ত। প্যারিসে হামলার ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই ছয় লাখ বারেরও বেশি ব্যবহূত হয়েছে এই হ্যাশট্যাগ। এদিকে প্যারিসে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্যারিসের ফ্লাইটও বাতিল হয়। এতে করে প্যারিসের যাত্রীরা আটকে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই আশ্রয় দিতে চেয়েছেন #StrandedInUS হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে।
 
ফেসবুকের মতো #PrayForParis হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ে টুইটার আর ইনস্টাগ্রামেও। শুক্রবার রাতে হামলার পর শনিবার বিকালের মধ্যেই এই হ্যাশট্যাগটি টুইটারে ব্যবহূত হয় ৫৭ লাখ বার এবং ইনস্টাগ্রামে ব্যবহূত হয় ৪৮ লাখ বারেরও বেশি। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন উপকরণে তৈরি ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা, আইফেল টাওয়ার প্রভৃতির ছবিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।
 
এ ছাড়াও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই প্যারিস হামলার পর পাশে এসে দাঁড়ায় ফ্রান্স ও প্যারিসের। অনলাইন মার্কেটপ্লেস এয়ারএনবি ঘটনার পরপরই ত্রাণ কর্মসূচি চালু করে এবং আশ্রয়প্রার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত রাখে নিজেদের। এদিকে স্প্রিন্ট, ভেরিজন ও টি-মোবাইল ঘটনার পর ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভয়েজ কল ও টেক্সট মেসেজ সার্ভিস উন্মুক্ত করে দেয় বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য। গুগলও তাদের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ‘হ্যাংআউট’ উন্মুক্ত করে দেয় সকলের জন্য। এ ছাড়া ফ্রান্সের প্রতি সমর্থন জানাতে ইউটিউব, অ্যামাজন, রেড্ডিটের মতো ওয়েবসাইটও নিজেদের হোমপেজ ও লোগোতে যুক্ত করে ফ্রান্সের পতাকা।
 
সমালোচনার মুখেও ফেসবুক
 
প্যারিসে হামলার পর ফ্রান্সের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন জানানোর নানা ধরনের সুযোগ করে দিয়ে ফেসবুক প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি সমালোচিতও হয়েছে। প্যারিসে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই ‘সেফটি চেক’ ফিচার চালু করে ফেসবুক। গত বছরের অক্টোবরে প্রথম চালু হওয়া এই ফিচারটি অবশ্য একদিন আগেই বৈরুত হামলায় অন্তত ৪৩ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর চালু করা হয়নি। তাছাড়া ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিকে ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙানোর সুযোগ ফেসবুক চালু করলেও অন্যান্য দেশের নানা ধরনের হামলার ঘটনায় এমন সুযোগ ফেসবুক তৈরি করেনি। এ কারণে ফেসবুকের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অনেকেই। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ অবশ্য খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বিষয়টি নিয়ে। অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে জুকারবার্গ লিখেন, ‘অনেকেই জানতে চেয়েছেন প্যারিসের জন্য সেফটি চেক ফিচারটি চালু করা হলেও তা কেন বৈরুত বা অন্যান্য শহরের ঘটনার জন্য করা হয়নি। গতকাল পর্যন্ত এই সেফটি ফিচার কেবল প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার জন্যই সক্রিয় করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। তবে এখন থেকে আমরা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা বা হামলার ক্ষেত্রেও এই ফিচারটি চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’ ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারীই অবশ্য জুকারবার্গের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি। তারা ফেসবুকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন সব দেশ ও শহরের জন্য একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে ফেসবুক।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top