যে পথে মিলবে পরকালের সফলতা

S M Ashraful Azom
0
যে পথে মিলবে পরকালের সফলতা
সেবা ডেস্ক: যারা আল্লাহকে রব হিসাবে স্বীকার করেছেন এবং হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসাবে মেনে নিয়েছেন তারাই মুমিন। তারাই মুসলমান।
আর ঈমানের সঙ্গে সঙ্গে আমলে সালেহ তথা নেক কাজ থাকলে সে প্রকৃত ও সফল মুমিন। সে জান্নাতি। ঈমান গ্রহণের পর সেই ঈমানের কিছু দাবি-দাওয়া ও তাকাযা (চাহিদা) থাকে। ঈমানের সেই তাকাযা পুরা করাই হলো আমলে সালেহ। তাই ঈমানের সঙ্গে সঙ্গে তার তাকাযা পূরণ তথা আমলে সালেহও করতে হবে এবং আমরা যারা দাওয়ার ময়দানে কাজ করি তাদেরও বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে।

প্রকৃত সফল মুমিনের পরিচয় স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কোরআনে হাকিমে দিয়েছেন। সাত ধরনের গুণে গুণান্বিত মুমিনগণ সফল। তারা জান্নাতে চিরকাল থাকবে।

(১) যারা তাদের নামাজে বিনয়ী ও নম্র হয়। এই গুণ খুশু খুযুর দ্বারা অর্জন হয়। অন্তর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্থিরতাকে বলা হয় খুশু। আর আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা হলো খুযু। নামাজে খুশু খুযু তথা বিনয় ও নম্রতা আনার মাধ্যম হলো, আল্লাহকে হাযির নাযির জানা। আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য সামনে রেখে নামাজ পড়া। কেননা যেকোনো সেক্টরে বড়দের উপস্থিতি অনুভব হলে অধিনস্তরা গুরুত্ব ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করে থাকে। অতএব আল্লাহকে হাযির নাযির জ্ঞান করে তার বড়ত্ব-মাহাত্ম্য মনে রাখলে, বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবে।

(২) যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে। হাদিসে এ অর্থটি লগবো শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে। লগবো অর্থ অনর্থক, অহেতুক কথা, কাজ ও চিন্তা-ভাবনা। লগবো এমন কথা বা কাজ, দুনিয়াতে যার কোনো উপকার নেই। আখেরাতে কোনো সাওয়াব নেই। যেসব মুমিন লগবো থেকে বিরত থাকে, তারা ঈমানের অন্যতম সিফাত অর্জনকারী। সাহাবি হজরত উকবা ইবনে আমের (রা.) আমাদের নবীজি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! নাজাত (মুক্তি) কী? উত্তরে নবীজী (সা.) তিনটি কথা ইরশাদ করলেন-

(ক) তোমার ওপর তোমার জিহ্বার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করো। অর্থাৎ, তোমার জিহ্বাকে অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে বিরত রাখো। আল্লাহ তায়ারা সূরা ক্বাফ এর ১৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন- ‘বান্দা তার মুখ থেকে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা-ই লিপিবদ্ধ করার জন্য তার কাছেই রয়েছে অতন্দ্র প্রহরী ফিরিশতা।’ কথাটি নেক হলে ডান কাঁধের ফেরেশতা, আর খারাপ হলে বাম কাঁধের ফেরেশতা লিপিবদ্ধ করে নেয়। (বয়ানুল কোরআন)। (খ) তোমার ঘর যেন কষ্ট করে। এ কথার ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা তীবি (রহ.) বলেন- তোমার ঘর যেন আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে লিপ্ত থাকে। অহংকার মুক্ত থাকে। আবার কোনো কোনো মুহাদ্দিস এর ব্যাখ্যায় বলেছেন-আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য যে স্ত্রী সন্তান, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ইত্যাদি দুনিয়ার আসবাবপত্র বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকো এবং দীনের বিষয়ে তোমার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্নের দিকে তাকাও। আর দুনিয়ার বিষয়ে তোমার চেয়ে নিম্ন শ্রেণির দিকে লক্ষ করো। যাতে আল্লাহর নিয়ামত তোমার কাছে তুচ্ছজ্ঞান না হয়।  (গ) তোমার কৃত গুনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হও। এ তিনটি কাজ করলে তুমি নাজাত পাবে। (তিরমিযী।)

(৩) যারা জাকাত আদায় করে। ধন সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি কাউকে বিত্তশালী, কাউকে রিক্তহস্ত বানান। যাদেরকে বিত্ত দান করেন, তাদের শরিয়ত নির্ধারিত হারে তথা শত করা আড়াই পার্সেন্ট জাকাত হিসাবে হত-দরিদ্র, গরীব-দুঃখিকে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বারবার ইরশাদ করেছেন- তোমরা জাকাত আদায় করো। যারা মালের জাকাত আদায় করে নিজের সম্পদ পবিত্র করে, তারা মুমিনের বিশেষ গুণে গুণান্বিত। অনেক মুফাসসিরীনে কিরাম এই পয়েন্টে তাযকিয়ায়ে নফ্স তথা আত্মশুদ্ধির কথা বলেছেন। হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানবী (রহ.) বলেন, এখানে জাকাত দ্বারা প্রসিদ্ধ জাকাত উদ্দেশ্য নয়। বরং তাযকিয়ায়ে নফস উদ্দেশ্য। কারণ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ। আর জাকাত মক্কায় ফরজ হয়নি বরং মদীনায় ফরজ হয়েছে। (বয়ানুল কোরআন) অর্থাৎ, যারা (আমল-আখলাকে) নিজেকে পরিশুদ্ধ করে। সূরা সূরা আল আ’লা এর ১৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- অবশ্যই সফল হয়েছে সেই ব্যাক্তি যে আত্মার শুদ্ধতা অর্জন করেছে। সূরা শামসের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- নিশ্চয়ই সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে (আত্মাকে) বিশুদ্ধ করেছে। আর নিশ্চয়ই সে বিফলকাম হয়েছে, যে তাকে কলুষিত করেছে। অতএব আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা ঈমানের এক বিশেষ সিফাত।

(৪) যারা নিজেদের লজ্জাস্থানকে সংযত রাখে। অপাত্রে অবৈধ স্থানে এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। হজরত সাহাল ইবনে সাআদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, আমাদের প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থান অপাত্রে ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দিবে, আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিব (সহীহ বুখারি।) চোখের হেফাজত লজ্জাস্থান সংযত রাখার অন্যতম সহায়ক। অতএব দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হবে। বেগানা নারী, অশ্লীল ছবি ও ফিল্ম দেখা থেকে চোখকে হেফাজত করতে হবে।

(৫) যারা আমানত রক্ষা করে। আমানতে খিয়ানত করে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন- তোমরা আমানতসমূহ তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দাও। আমানত দুই ধরনের হতে পারে। (ক) গচ্ছিত সম্পদ। (খ) অর্পিত দায়িত্ব। পরিবার, সমাজ, অফিস-আদালত ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বও আমানত। সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন না করলে খিয়ানত হবে। খিয়ানত পরিমাণ বেতন-ভাতা বৈধ হবে না। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দীন ও শরীয়ত উম্মতের কাছে রেখে গেছেন তাও আমানত। অতএব দীন ও শরিয়তকে সংরক্ষণ করা, এর তাকাযা পূর্ণ করা উম্মতের ওপর মহান দায়িত্ব। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়। (মুসনাদে আহমাদ, শুআবুল ঈমান)। বৈঠকের কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তও আমানত। কোনো কোনো সাহাবি নবীর দরবারের পরামর্শ বাইরে প্রকাশ করে দিতেন। এতে মুনাফিকরা ইয়াহুদীদের আগে আগে সতর্ক করে দিতো। তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করলেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং নিজেদের আমানতের বস্তুগুলোতে খিয়ানত করো না। (সূরা: আল-আনফাল, আয়াত ২৭)।

(৬) যারা ওয়াদা পূর্ণ করে। ওয়াদা পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। ওয়াদা রক্ষা না করা মুনাফিকের নিদর্শন। হাদিস বর্ণনাকারী বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। (ক) মুনাফিক যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। (খ) ওয়াদা করলে, তা রক্ষা করে না। ভঙ্গ করে। (গ) আমানত রাখলে, খিয়ানত করে। (বুখারি, মুসলিম)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, অপর এক হাদীসে নবীয়ে আকদাস (সা.) ইরশাদ করেন, যার মধ্যে চারটি স্বভাব থাকবে,  সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ চারটির কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তার মধ্যে নিফাকের একটি খাসলত থাকলো। (১) যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, খিয়ানত করে। (২) যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। (৩) যখন ওয়াদা করে, প্রতারণা করে তা ভঙ্গ করে। (৪) যখন বিতর্ক করে, অন্যায় করে। মুহাদ্দিসিনে কিরাম চতুর্থ খাসলতের ব্যাখ্যায় বলেন, যখন বিতর্ক ও বিবাদ বা মামলা করে, তখন হক ও সত্য থেকে বের হয়ে মিথ্যা বলে। এমনকি হককে বাতিল আর বাতিলকে হক প্রমাণ করে। (বুখারি, মুসলিম)। পূর্বে আমানতের আলোচনায় উল্লিখিত হাদীসে আল্লাহর নবী (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না, তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়।

(৭) যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হয়। নামাজ হলো ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী। ঈমানের পর সবচে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ। হাশরের বিচারিক মাঠে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেয়া হবে। সুতরাং নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া মুমিনের অন্যতম বিশেষ গুণ। আর নামাজের ব্যাপারে অলসতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন মুনাফিকের কাজ। সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়ীতে উল্লেখিত এক হাদীসে নবী কারীম (সা.) অলসতা, অবহেলা করে আছরের নামায সূর্য ডুবার আগে আগে পড়াকে মুনাফিকের নামাজ আখ্যা দিয়েছেন। অতএব প্রকৃত মুমিন হতে হলে নামাজে যত্নবান হতে হবে। উল্লিখিত গুণে যারা গুণান্বিত হবে, তারাই হবে জান্নাতের উত্তরাধিকারী। তারা ফিরদাউস জান্নাতের মালিক হবে। যেখানে তারা চিরকাল থাকবে।

সফল মুমিনের এ গুণগুলো পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনের প্রথম নয় আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অতএব মুমিন জীবনে সফলতা পেতে হলে এ গুণগুলো অর্জন করতে হবে। মুমিনের এ সিফাতগুলো নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই প্রযোজ্য। তবে আমি তরুণ ও যুব সমাজকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কারণ যৌবনকালের ইবাদত আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। হাদিসের ভাষ্যমতে তরুণ ও যুব সময়ে যারা আল্লাহর ইবাদত করবে, তারা কিয়ামতের কঠিন ময়দানে আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবে।

এছাড়া তারা আগামী দিনের সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। দেশ ও জাতির রাহবার। তাদের আগামী দিনে অনেক পথ পারি দিতে হবে। দাওয়াতে দীন ও ইসলামের জন্যে, ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে, সত্যকে বিজয় করতে, দুঃখিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, মানবতা ও শান্তির রাষ্ট্র কায়িম করতে তাদের আন্দোলন সংগ্রাম ও জিহাদের অনেক কণ্টকাকীর্ন পথ পারি দিতে হবে। যে পথে মহান আল্লাহর মদদ ছাড়া বিজয় আসে না। আর ইমানের সিফাত অর্জন করে পূর্ণ ঈমানি শক্তিতে বলিয়ান না হলে আল্লাহর পূর্ণ মদদ মিলবে না।

আমার বিশ্বাস তারা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাহলেই একটি শান্তির রাজ কায়িম করা সম্ভম হবে। যে সমাজে থাকবে না কোনো সুদ-ঘুষ ও দুর্নীতি। থাকবে না খুন গুম ছিনতাই ও রাহাজানী। বরং সকলে মিলে-মিশে এক আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবে। ঐক্যবদ্ধভাবে একটি সভ্য সমাজ, আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণ করবে। মহান আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন।

⇘সংবাদদাতা: সেবা ডেস্ক
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top