দিন দিন এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে ঝুঁকি বেড়েই চলেছে

S M Ashraful Azom
0
দিন দিন এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে ঝুঁকি বেড়েই চলেছে
সেবা ডেস্ক: বাসা-বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানের রান্নার কাজে ব্যবহৃত এলপিজির (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সবার মাঝে জনপ্রিয় হলেও সিলিন্ডার গ্যাসের এই ব্যবহার ইদানীং আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। গত পাঁচ বছরে গ্যাস সিলিন্ডার-সংক্রান্ত পাঁচ শতাধিক ঘটনায় দুই শতাধিক লোক হতাহত হয়েছেন। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অসচেতনতা, মানহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার এবং উপযুক্ত তদারকির অভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে। তবুও সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার ও পরিবহন থামছে না। বিশেষ করে খুচরা পর্যায়ে সিলিন্ডার বিপণন ও বিতরণে নিয়ম মানা হচ্ছে না। এতে সিলিন্ডারের স্থায়িত্ব কমছে। ঘটছে দুর্ঘটনা।

রান্নার কাজে এলপিজির ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালে। পাইপলাইনে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ বন্ধের পর কয়েক বছরে এটি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে এখন দুই কোটির বেশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহূত হচ্ছে। বাসাবাড়ি ছাড়াও হোটেল, রেস্তোরাঁ, অটোমোবাইল, ক্ষুদ্রশিল্পের জ্বালানি হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

দুর্ঘটনা:
গত ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্দর থানার কলসী দীঘিরপাড় ধামুপাড়া এলাকার একটি বাসায় রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরিত হয়। এতে ওই বাসার গৃহকর্ত্রী রাজিয়া আক্তার (৪৫) এবং তার ছেলে মো. ইয়াছিন (২৩) ও মেয়ে তানিয়া (১৯) দগ্ধ হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জুলাই রাজিয়া আক্তার মারা যান।
৩ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরণে আব্দুর রশিদ নামে এক ব্যক্তির পা উড়ে যায়। এভাবে প্রায়ই দেশজুড়ে সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এ ধরনের পাঁচ শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। হতাহত হয়েছে দুই শতাধিক। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গ্যাস বিস্ম্ফোরণে ২০১৮ সালে ১৭৮, ২০১৭ সালে ৭৯, ২০১৬ সালে ১৩১ এবং ২০১৫ সালে ৮০টি দুর্ঘটনা ঘটে।

এলপিজির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন ও বিকিকিনি :

এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের ব্যবহার জীবনকে যেমন সহজ করেছে তেমনি বাড়িয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এবং অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ ব্যবহারের ফলে এগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী নিজেরাই সিলিন্ডার ভরে গ্যাস বিক্রি করছে। এটাকে বলা হচ্ছে ক্রস ফিলিং। এটা অনিরাপদ। কারণ এলপিজি কোম্পানিগুলোতে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বাল্ক্ব ও সেফটি ক্যাপ বসানো হয়। আর ক্রস ফিলিংয়ে হাতের সাহায্যে বাল্ক্ব বসানো হয়। তাই সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে বিস্ম্ফোরক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলেন, পরিবহনের সময় সিলিন্ডার কাত করে বা শুইয়ে রাখলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। ট্রাকে তোলার সময় অনেক সময় শ্রমিকরা সিলিন্ডার ছুড়ে দেয়। এতে সিলিন্ডারের নিরাপত্তা বেষ্টনী দুর্বল হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া গ্রাহক পর্যায়ে সিলিন্ডার বহন পদ্ধতিও নিরাপদ নয়। মফস্বলে এমনকি খোদ রাজধানীতে দেখা যায় সাইকেলের পেছনে-সামনে বিশেষ ব্যবস্থায় ঝুলিয়ে ও শুইয়ে তিন-চারটি সিলিন্ডার বহন করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীর মগবাজার, রামপুরাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায় মহল্লার দোকানের কর্মীরা সাইকেলের দু'পাশে সিলিন্ডার বহনের জন্য বিশেষ কাঠামো তৈরি করেছে। দু'পাশে দুটি সিলিন্ডার রাখার পর তাদের ওপর শুইয়ে আরেকটি সিলিন্ডার বহন করা হচ্ছে। জানতে চাইলে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার একজন সিলিন্ডার ব্যবসায়ী বলেন, আশপাশের গ্রাহকদের কাছে সাইকেলের মাধ্যমে সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হয়। এমন করে পৌঁছানো তো নিরাপদ কি-না- এমন প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, দু-একটি সিলিন্ডার তো পিকআপে করে দিয়ে আসা সম্ভব নয়।

যদিও গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার কোনো দ্বিচক্রযানে (মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল) পরিবহন করা যাবে না। কোনো যানে সিলিন্ডার পরিবহনের ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের কোনো অংশ ওই যানের বাইরে থাকা চলবে না।

জানতে চাইলে, ওমেরা এলপিজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হক বলেন, তারা ডিলার পর্যন্ত সিলিন্ডার পৌঁছাতে নিরাপত্তার সব নিয়ম মেনে চলেন। মূলত অনিয়মটা হয় ডিলার পর্যায়ে। তারা সিলিন্ডার সংরক্ষণ ও পরিবহনে নিয়মগুলো মানতে চান না। ছোট ছোট স্থানে এলোমেলোভাবে সিলিন্ডার রাখেন। খরচ বাঁচাতে সাইকেলে করে পরিবহন করেন। যদিও বারবার তাদের বলে দেওয়া হয়, সিলিন্ডার কখনও হেলে বা শুইয়ে পরিবহন করা যাবে না, দুর্ঘটনা ঘটবে। এজন্য ডিলারদের নিয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও করা হয়।

বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তরের পরিচালক মো. সামসুল আলম বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বহনে ও সংরক্ষণে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। তিনি বলেন, সাইকেলের মতো বাহনে সিলিন্ডার বহন ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে গ্রাহক ও ডিলার সবাইকে সচেতন হতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাদের সীমিত জনবলে মাঠ পর্যায়ে বিশদ তদারকি সম্ভব হয় না।

দেশজুড়ে এলপিজি ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটলেও সিলিন্ডারের মান তদারকিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসির সিলিন্ডার পরীক্ষার জন্য মাত্র একটি কেন্দ্র রয়েছে, তাও চট্টগ্রামে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিলিন্ডার নিরীক্ষা করে।

সিলিন্ডার ব্যবহার আসলে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে যমুনা এলপিজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলায়েত হোসেন বলেন, বাজারে তাদের ৫০ লাখ সিলিন্ডার আছে। প্রতিটির মেয়াদ ২৫ থেকে ৩০ বছর। এই মেয়াদকালে তিনবার সিলিন্ডারের নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে ১০ বছর, এরপর ১৫ বছর, এরপর পাঁচ বছর পর। এ ছাড়া প্রতিবার গ্যাস ভরার সময় তারা হাইড্রো টেস্ট করেন। কোনো সমস্যা দেখলে সেই সিলিন্ডার বাতিল ঘোষণা করেন। দুর্ঘটনা ঘটে ব্যবহারে অসচেতনতা ও অসাধু ডিলারদের অসৎ ব্যবসার কারণে। তার মতে, গ্রাহকরা সচেতন নন।

চাহিদা অনুযায়ী বার্ষিক ১৫ লাখ টনের বেশি এলপিজি সরবরাহ করা দরকার। তবে আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ টন। এর মধ্যে ২০ হাজার টন এলপিজি সরকারিভাবে বিক্রি হয়। আর বাজারে বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, ইউনিগ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, ইন্ট্রাকো, যমুনা, সেনা এলপিজি নামে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস বিক্রি করছে।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top