চোখের আলো ছড়ানোর আলো ঘরের কথা

S M Ashraful Azom
0
চোখের আলো ছড়ানোর আলো ঘরের কথা
সেবা ডেস্ক: আলো বিতরনের কারখানা এটি। তিন দশক ধরে আলো বিতরন করে যাচ্ছে। একটি, দুটি নয়, একশ’, দুইশ’ নয়। হাজারে হাজারও নয়। এ সময়ে পাঁচ লাখেরও বেশি আলো বিতরন করেছেন তারা। বলতে গেলে একেবারে বিনে পয়সায় এ আলো বিতরণে পাঁচ লাখ মানুষ পেয়েছেন আশার আলো। মন ভরে দেখছেন পৃথিবীকে। শ্বাস নিচ্ছেন সুখ টানে।

এমনই একজন তরুণ কুমার মহলানবীশ। নারিন্দার গুরুদাস সরকার লেনের বাসিন্দা। বয়স ষাট পেরিয়েছে। পেশায় বানান বিশারদ। ভুলে ভরা পাণ্ডুলিপি  সংশোধন, পরিমার্জন ও সম্পাদনা করেন। কিন্তু গত এক বছর খুব কষ্টে ছিলেন চোখ নিয়ে। ধীরে ধীরে কোনো এক প্রলেপ যেন তার চোখের আলো আটকে দিচ্ছে। তার উপর পেয়ে বসেছে ডায়াবেটিস। কী করবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা। চোখ যদি ঠিকমতো কাজ না করে তাহলে বানান ঠিক করবেন কি করে? আর চোখের চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন? দুশ্চিন্তার মধ্যেই আশার আলো দেখতে পান তিনি। খোঁজ পান একটি দাতব্য চক্ষু হাসপাতালের। যারা শুধু চোখের যত্নেই কাজ করে। খরচও কম। মাত্র দশ টাকা ফি দিয়ে দেখানো যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তাছাড়া প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো বাড়তি ফি নেই। দফায় দফায় পরীক্ষা আর সবশেষে ছানি অপারেশনে তিনি এখন চোখের আলো ফিরে পেয়েছেন। বসেছেন ফের বানানের টেবিলে।

যে হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন তার অবস্থান পুরনো ঢাকার ফরাশগঞ্জে। মাওলা বক্স চক্ষু হাসপাতাল। প্রাতিষ্ঠানিক নাম, মাওলা বক্স সরদার দাতব্য চক্ষু হাসপাতাল। সকাল নয়টায় হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশের পরই দেখা গেল রোগীদের ভিড়। হোল্ডিং নম্বর ২৪ মোহিনী মোহন দাস। শুধু হাসপাতাল নয়, এখানেই অবস্থিত ঢাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা কেন্দ্র’। রয়েছে নানান বৃক্ষরাজিশোভিত ছাদ বাগান। তবে মূল কাজ সাধারণ মানুষের চোখের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। মাত্র ১০ টাকা ফিতে রোগীরা চোখ পরীক্ষা করছে। এ যেন অসংখ্য আলো হারানো মানুষের আশ্রয়স্থল। ধুঁকে ধুঁকে অন্ধ হতে বসা থেকে চোখ বাঁচিয়েছেন শুধু একজন তরুণ কুমার নন। শত শত। হাজার হাজার। তিন দশকে চিকিৎসা নেয়া নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে পাঁচ লাখ।
ফরাশগঞ্জে এই দাতব্য হাসপাতালের সূচনা ১৯৮৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারিতে। প্রথম রোগী ছিলেন এলাকার বিহারীলাল জিঁউ আখড়ার পুরোহিত হুনুমানজী। সেই থেকে শুরু। নানা উত্থান-পতন আর সংকটেও পথচলা থামেনি। আশাহত হননি এর কর্ণধার। পিতৃ প্রতিশ্রুতি আর দেশপ্রেম এই দুই তাগিদ নিয়ে কর্মযজ্ঞ এগিয়ে নিয়েছেন মাওলা বখ্শের উত্তরসূরি মোহাম্মদ আজিম বখ্শ। তার স্বপ্রাণ প্রচেষ্টা আর উদ্যোগে একটু একটু করে লাখো মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এই হাসপাতাল। ‘দাও আলো, দাও জীবন’  স্লোগানে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে মওলা বক্স দাতব্য হাসপাতাল।

যেভাবে শুরু: ঢাকার শেষ সরদার ছিলেন মাওলা বখ্শ। তিনি ছিলেন ফরাশগঞ্জ এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান। এলাকার উন্নয়নে তিনি বরাবরই ছিলেন উদার। লালকুঠির মাঈনুদ্দিন চৌধুরী হল, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবসহ এলাকার উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মহতী এই মানুষটি ১৯৮৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি পরলোকগমন করেন। আর মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছেলে ও মেয়েকে তার সম্পত্তি মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের কথা বলে যান।

বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণে মাওলা বখ্শের ছেলে আজিম বখ্শ গঠন করেন ‘মাওলা বক্স মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। ট্রাস্টের অধীনে মানবতার সেবায় চারটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো দুস্থ ও অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ প্রকল্প।
এ প্রকল্পের আওতায় ২৫ শয্যার একটি চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। প্রথমদিকে একজন চিকিৎসকের অধীনে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের পরিধি এখন অনেকগুণ বেড়েছে। প্রথমদিকে কোনো ফি নেয়া হতো না। পরে ২০০৪ সাল থেকে তার বদল ঘটে। এ বছরই চোখের লেন্স  ইমপ্লান্ট শুরু হলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এই উদ্যোগে শরিক করাতেই ফি নেয়া শুরু হয় নাম মাত্র ১০ টাকা। চোখের ছানি অপারেশন, লেন্স সংযোজন, নেত্রনালী অপারেশনসহ আরো অনেক গুরুতর চোখের চিকিৎসা করা হয় এখানে।

শুরু থেকেই আগত রোগীদের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আধুনিক চক্ষু চিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে যখন যে ইকুইপমেন্টের প্রয়োজন পড়েছে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শুরুতে অপারেশনের রোগী পাঁচদিন হাসপাতালে রাখা হতো। ওই রোগীর জন্য পাঁচদিনে খাবার সময়মতো নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন পরিবারের সদস্যরাই।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রোগীর সিরিয়াল দেয়া হয়। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। সম্প্রতি শিশুদের জন্য নতুন আরেকটি বিশেষ শাখা চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল শিফটে ৩০০ জন রোগী এ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ বিশেষ শাখায় তুলনামূলক কম খরচে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা।

কেন চক্ষু হাসপাতাল: ট্রাস্ট করা হয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে তো অন্য অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করা যেতো। সব ছাপিয়ে কেন চক্ষু হাসপাতাল? এর উত্তর দিয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম বখ্শ। তিনি বলেন, মানুষের শরীরের মধ্যে চোখ খুবই সংবেদনশীল। সামান্য অবহেলায় মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে আমরা চোখকেই বেছে নিয়েছিলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজের বাবার চিকিৎসার অভিজ্ঞতাও স্মরণ করেন। বাবা মাওলা বখ্শ সরদার চোখে ছানি সমস্যা নিয়ে ভুগেছেন। তা আশির দশকের কথা। তখন ঢাকায় চক্ষু হাসপাতাল বলতে ইসলামিয়া ও সরকারি চক্ষু হাসপাতাল। দূরত্ব বিবেচনায় বাসায় ডাক্তার নিয়ে আসা হলো। সব দেখে তিনি বললেন অপারেশন করতে হবে। ক্লিনিকে ভর্তি হতে হবে। সব শুনে মাওলা বখ্শ বললেন, অপারেশনের সব আয়োজন যদি বাসায় করি তাহলে অপারেশনটা বাসায় নয় কেন? শুনে ডাক্তার মৃদু হেসেছিলেন। ঘটনাটা আজিম বখ্শের মনে দাগ কেটেছিল। অন্যদিকে এক নিকটাত্মীয়ের চোখ পরপর দু’বার অপারেশন করার বিরূপ অভিজ্ঞতা এবং সবশেষ অন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণার কথাও তিনি ভুলতে পারেন নি। এই দুটি অভিজ্ঞতা আজিম বখ্শকে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তুলতে তাগিদ যোগায়। আশির দশকে মাত্র একজন চিকিৎসক আর দু’তিনজন সহযোদ্ধা নিয়ে কাজ শুরু করেন। একে একে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন অনেকেই। আর সেই চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে পুরো হাসপাতালজুড়েই। কেউ হয়তো একটি বেড দিয়েছেন, কেউ হয়তো একটি কক্ষ নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। সেখানকার এক একটি কেবিন বা কোনো দামি মেশিন এমনকি একটা বেডও কেউ না কেউ উপহার দিয়েছেন। তাই তো চেয়ার-টেবিল, বেড আর কক্ষের গায়ে লেখা আছে অমুকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

আগামীর পরিকল্পনা: হাসপাতালের পরামর্শক ও সমন্বয়কারী মো. আবুল কাশেম টিটু বলেন, রোগীদের চোখের সুরক্ষায় সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দিনে দিনে এই সেবার মান আরো কীভাবে উন্নত করা যায় সেটাই আমাদের চেষ্টা। সামনের দিনে হাসপাতালের বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে বলে জানান আজিম বখ্শ। তিনি বলেন, চিকিৎসা পরবর্তী চোখের যতœ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তা নিশ্চিতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকে মাওলা বক্স দাতব্য চক্ষু হাসপাতাল। আগামীর লক্ষ্য একটাই, চোখের চিকিৎসাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। আর তা নিশ্চিতে দিন-রাত কাজ করে চলেছেন আমাদের একদল কর্মী।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top