আলোর বাতিঘর বাঁশখালী উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী

S M Ashraful Azom
0
আলোর বাতিঘর বাঁশখালী উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী
শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী সংবাদদাতা: শিক্ষা একটা পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে, জাতীকে এমনকি পুরো পৃথিবীকেই বদলে দেয়। বদলে দেয় মানুষের চিন্তার ধরণ, বলন। একটি জাতীর মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রথম হাতিয়ার হল- সুশিক্ষা। মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে, বিবেককে প্রস্ফুটিত করতে, মনোবৃত্তিকে উদ্বেলিত করতে বহুমুখী শিক্ষার বিকল্প নাই। বহুমুখী শিক্ষার একমাত্র উন্মোক্ত মাধ্যম হচ্ছে লাইব্রেরী বা পাঠাগার। পাঠাগারকে একটি মহাবিদ্যালয়ের সাথে তুলানা করা যায়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে অতীত ও বর্তমানের সাথে সেতুবন্ধন স্থাপন করে পাঠাগার। এখানে হাত দিলেই হাতের স্পর্শে জ্ঞানের রাজ্যে সাঁতার কাটানো যায়। কালো কালো অক্ষরে বাঁধা হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সম্ভার, গুণীদের অমীয় বাণী হাতের নাগালে পেতে যার কথা প্রথমে আসে তা হলো একটি লাইব্রেরী/পাঠাগার। অন্ধজনে আলোর দেখা, অজীব প্রানে মনুষ্যত্বের সঞ্চার ঘটাতে পাঠাগারের কোন বিকল্প নাই। তাই পাঠাগার গড়ে উঠুক পরিবারে, সমাজে, পাড়ায় পাড়ায়। পাঠাগারে সমৃদ্ধ হোক আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি।

আজকাল তথ্য প্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেটের বাহুল্যতায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম সঠিক জ্ঞানচর্চা থেকে দিন দিন বিমুখ হচ্ছে। ফেইসবুক, ইন্টারনেটের মতো সোস্যাল মিডিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। দিন দিন প্রজন্মে ঘূণে ধরছে, লোপ পাচ্ছে মনুষ্যত্ব। কারণ হিসেবে দেখা যায়- আমরা সঠিক জ্ঞান আহরণ করছিনা বলে। আমরা জ্ঞান অর্জনের জন্য বই পড়ি, মনের খোরাক  মেটানোর জন্য বই পড়ি। এজন্য চাই হরেক রকম বইয়ের সমাহার। চাই পছন্দের বই। কিন্তু চাহিদা থাকলেও অনেক সময় সাধ্যের মধ্যে থাকেনা পছন্দের বই জোগাড় করার সামর্থ। একারণেই গড়ে উঠে গ্রন্থাগার। পাঠক সেখানে গিয়ে নিরিবিলি পরিবেশে একাগ্রতা নিয়ে বই পড়েন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে আমাদের  দেশে এখনও  সেভাবে পাঠাগার গড়ে ওঠেনি। প্রয়োজনের তুলনায় মানসম্মত পাঠাগারের সংখ্যার বাড়েনি। আর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলোতে পাঠাগার  নেই বললেই চলে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়া  থেকে গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোররা তাই একরকম বঞ্চিতই বটে। এ সমস্যা  থেকে উত্তরণে শিশু-কিশোরদের হাতে বই তুলে দিতে চট্টগ্রামের বাঁশখালী  উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী গ্রামে  বিগত ২০১০সালে প্রতিষ্ঠিত হয় উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী।

মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠা 'উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী' উপকূলের বাতিঘর হিসেবেখ্যাত এ পাঠাগারকে ঘিরে এখন বই পড়ার আনন্দে  মেতেছে এলাকার তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। প্রায় ১৫০ জন নারী সদস্য লাইব্রেরী থেকে নিয়মিত বই ধার নিয়ে ঘরে বসে অধ্যয়ন করেন। দূরের গ্রামের বই পাঠকরাও লাইব্রেরী থেকে বই ধার নিয়ে অধ্যয়ন করেন নিয়মিত।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রতিদিন বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠকের জন্য খোলা থাকে এই গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে লাইব্রেরীয়ান হিসেবে দায়িত্বরত জান্নাতুল হুরি জানান, আমাদের লাইব্রেরী প্রতিদিন বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। তিনি জানান, লাইব্রেরীতে বর্তমানে নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা দুই শতাধিক। প্রতিদিন গড়ে ৩০/৩৫ জন পাঠক লাইব্রেরীতে বই পড়তে আসেন।

লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম আল হাবিব জানান, উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী এখানকার উপকূল এলাকার জন্য একটি আলোকিত বাতিঘর। গ্রামের সব শিক্ষার্থী , শিক্ষক ও বইপ্রেমী মানুষের জন্য এটি জ্ঞানার্জনের জন্য একটি নিরিবিলি প্রতিষ্ঠান। জাহাঙ্গীর আলম জানান, পাঠকের তুলনায় গ্রন্থাগারে এখনো বইয়ের সংখ্যা কম। তিনি আরো বলেন, অন্য দশটি গ্রন্থাগারের চেয়ে আমাদের গ্রন্থাগারে পাঠকের উপস্থিতি অনেক বেশি।

খুদুকখালী গ্রামের স্থানীয় মসজিদের খতিব মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নিরিবিলি বইপাঠের জন্য উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমরা ্খানে নিয়মিত বই পড়ি । পাঠকের চাহিদা পূরণে গ্রন্থাগারের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আরো বেশি বইয়ের প্রয়োজন রয়েছে।

সূত্রমতে, লাইব্রেরীর নামে ক্রয়কৃত প্রায় ২২ শতক জমির জমির ওপর টিনের ছাউনির এ পাঠাগারে রয়েছে এক হাজারেরও অধিক বই। ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ , ধর্মীয়, সাহিত্য ও বিজ্ঞানসম্মত এসব বই দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহ করে আসছে লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ। আর এসব বই সংগ্রহের পিছনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে  দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যানুরাগীরা। 

বর্তমানে লাইব্রেরীতে রয়েছে তিনটি বুক সেলফ। চারটি টেবিল ও দশটি চেয়ার। এসব আসবাবপত্র দিয়ে  সেখানেই গাদাগাদি করে সাজানো হয়েছে সব বই। তাই পছন্দের বই খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হয় পাঠক মহলের। লাইব্রেরীতে নিয়মিত পত্রিকা পড়ারও ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন জাতীয়-স্থানীয় তিনটি পত্রিকা রাখা হয়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও পাঠকরা খুব সহজেই  দেশ-বিদেশের খবরাখবর পেয়ে থাকে। এছাড়াও  লাইব্রেরীতে নিয়মিত কবিতা চর্চা, সাহিত্য সভা ও মাসিক গল্প লেখা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আর এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে মূল্যবান শিক্ষার উপকরণমূলক সামগ্রী পুরস্কার তুলে  দেওয়া হয়। বর্তমানে পাঠাগারটি আধুনিকায়নের কাজ চলছে। সেসঙ্গে আরও বই সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

এই গ্রন্থাগারে নিয়মিত বই পড়তে আসা স্কুলছাত্রী আনার কলি  জানায়, এখানে আমরা ছড়া ও গল্পের বই পড়ি। পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবরাখবরও জানতে পারি।

পাঠাগারের আরেক পাঠক রুজিনা আকতার জানান, এই গ্রন্থাগার আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা। এই গ্রন্থাগারের মাধ্যমে আমরা মূল্যবান বইগুলো পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাগারটি আলোর ফেরি হিসেবে কাজ করবে।

এই ইউনিয়নের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী লায়ন আমিরুল হক এমরুল কায়েস জানান,  উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরীর কার্যক্রম বরাবরই প্রশংসনীয়। এটি আমাদের এলাকার জন্য একটি গর্বিত প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, এই গ্রন্থাগার আমাদের এলাকার জন্য আলোকবর্তিকা। এলাকায়  পাঠাগার নির্মাণের কাজ আমাদের মুগ্ধ করেছে। উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী' উপকূলে আলো ছড়িয়ে দিবে, অসমাজিক কার্যকালাপ থেকে বিরত থাকবে আমার প্রিয় জনপদ ছনুয়ার নতুন প্রজন্ম। আমি পাঠাগারের সমৃদ্ধি কামনা করি।

উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরী প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের পাশাপাশি  জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামুখী কর্মসূচি পালন করে আসছে। এছাড়াও সামাজিক ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ডও  চোখেপড়ার মতো। প্রতিমাসে লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে শতাধিক দারিদ্র শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় মাসিক শিক্ষাসামগ্রী। তাছাড়া অতি দারিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার ফরম ফি সহ ইউনিফর্ম ও স্কুল ব্যাগ প্রদান করা হয়।

এই গ্রন্থাগারের ভুমিদাতা-প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সাংবাদিক সাঈফী আনোয়ারুল আজিম জানান, ২০১০ সালে এলাকার স্থানীয় একটি সাইক্লোন সেল্টারে চারটি চেয়ার একটি টেবিল আর একটি বুক সেলফ নিয়ে লাইব্রেরীর কার্যক্রম করি। সাইক্লোন সেল্টারে ১ বছর লাইব্রেরীর কার্যক্রম চালানোর পর শুরু হয় লাইব্রেরীকে স্থায়ী রূপদানের লক্ষে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করি। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে লাইব্রেরীর নামে ক্রয় করা হয় ২২ শতক জমি। বর্তমানে ক্রয়কৃত জমির উপর নির্মিত গ্রন্থাগারে পরিচালিত হচ্ছে লাইব্রেীর যাবতীয় কার্যক্রম। তিনি বলেন, আমরা অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই গ্রন্থাগারকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপদান করেছি। আমাদের লাইব্রেরী বর্তমানে উপকূলের বাতিঘর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top