এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আগাছাও বেশি জন্মে- বঙ্গবন্ধু

S M Ashraful Azom
0
এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আগাছাও বেশি জন্মে- বঙ্গবন্ধু

সেবা ডেস্ক: যুগে যুগে কিছু মানুষ আসেন, যাঁদের কাছে পরাজিত হয় সময়, তাঁরা অতিক্রম করেন মহাকালকেও। তাঁরা ইতিহাস নয়, প্রতি মুহূর্তের জন্য বর্তমান- আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন ভবিষ্যতের জন্য। তেমন একজন মানুষকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস আমার নেই।
 
মহাকালের পাতায় পাতায় এমন কিছু মানুষ পদচিহ্ন আঁকেন, তাঁদের অনুকরণ তো দূরের কথা, অনুসরণ করাও অসম্ভব। সাধারণের যুক্তিতে ধরে না তাঁদের ভাষা, তাঁদের কথা। তাঁদের যে জীবন- সেটা মিশে যায় আনন্দলোকে আর মঙ্গলালোকে। এমন আলোকোজ্জ্বল এক মানুষকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস তো আমার নেই।

বাঙালির ইতিহাস, হাজার বছরের। দীর্ঘ শাসন-শোষণে বিপর্যস্ত। কিন্তু এই হতোদ্যম জাতিকে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে একটি স্বাধীন অস্তিত্ব দেয়ার চেষ্টা করে যিনি সফল হয়েছেন, ধাপে ধাপে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে শৃঙ্খল ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছেন, যাঁর কথায় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল হয় জনতা, যাঁর কথায় স্তব্ধ হয় প্রকৃতি আর পরিবেশ- এমন মানুষকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস আমার নেই।

আমি এমন এক বিরলপ্রজ মহানায়কের কথা বলছি- যাঁর সংগ্রাম ছিল চিরকাল নিপীড়িত, অসহায়, দুর্বল ও শোষিত মানুষের কল্যাণ করা। তাঁর নীতি ছিল শান্তিবাদী, অহিংসপন্থি, নীতিবান, গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিভূ, তথাপি একটি জাতিকে নিয়ে অহিংস পথ মাড়াতে মাড়াতে নিয়ে গেছেন এক সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে, যে কারণে পৃথিবী সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম একটি জাতি-রাষ্ট্র- বাংলাদেশ যার নাম। এমন মানুষকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস তো আমার নেই।

যাঁর রাজনীতি ছিল রাজনৈতিক দর্শনের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ- একদিকে উগ্র কট্টর রাজনীতি থেকে ভিন্নতর, অন্যদিকে গান্ধীর অসহযোগ, অহিংস নীতির আলোকে নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করা, দেশপ্রেমে তাঁর অনুসরণীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সাহসে-সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ বোস এবং দর্শনে, আচরণে, আন্দোলনে অনুপ্রাণিত মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ। তাঁকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস তো আমার নেই।
 
১৯,৮৬৪ দিনের এক জীবন। জীবন তো নয়, যেন এক মহাকাব্য। ক্ষণজন্মা মানুষ তো এ রকমই হন। তাদের একেকটি দিন তো শুধু ২৪ ঘণ্টার নয়, একেকটি বছর তো ৩৬৫ দিনের নয়। অনন্তকালের জাগতিক সময় লুকিয়ে থাকে তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে। সময় অতিক্রান্ত মানুষ তারা। সময় তাদের বাঁধতে পারে না। বরং সময় অনুসরণ করে তাদের পিছু পিছু। এমন মানুষকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস তো আমার নেই।

বরং আমি লিখতে চাই- একটি কিশোরকে নিয়ে, দিগন্ত বিস্তৃত ধু-ধু ফসলের মাঠের মতো বিশাল স্বপ্ন যাঁর চোখে। ভোরের শিশিরের মতো কোমল স্পর্শে যিনি জাগিয়ে তোলেন ঘুমন্ত জাতিকে। একটি পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়েও যাঁর কীর্তি ছড়ায় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে, বরং এমন এক সরল রেখার মতো মানুষকে নিয়ে লেখা অনেক সহজ।

মধুমতির তীরঘেঁষা টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, আর ১৯২০ সালের বাংলাদেশ। ১৭ মার্চ রাত ৮টায় হারিকেনের টিম টিম আলোয় জন্ম নেয়া এক শিশু। কে জানত একদিন এই শিশু আলো দেখাবে পুরো জাতিকে। কেউ কি ভেবেছে এটা। তাই এই স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুকে নিয়ে লেখা অনেক সহজ।

ডানপিটে আর মারকুটে, দুঃখে কাঁদে আর সুখে হাসে- জীবন যাঁর ঋদ্ধ এভাবেই, তিনিই একদিন হবেন জাতির ত্রাতা- এ আর বিচিত্র কি- একদিকে উদার মানবতাবাদী সরলতায় কোমল, অন্যদিকে কঠিন শপথে বলীয়ান- মানুষের কষ্ট-দুঃখ-বেদনায় যিনি কাতর, স্বাধীনতার মুক্তি আন্দোলনে দাবি আদায়ে তিনি ততখানি অনড়, অচল এবং সাহসী- তাই এমন এক মানুষকে নিয়ে লেখা সহজ।

যিনি বিশ্বাস করে ঠকতে দ্বিধা করেন না। দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না। একমাত্র তিনিই বলতে পারেন আমার শক্তি, আমার দেশের মানুষের ভালোবাসা। আমার দুর্বলতা? সেটা হলো আমি তাদের বেশি ভালোবাসি। তাই ভালোবাসতে বাসতেই জীবন দিয়ে দিলেন মানুষের জন্য। যিনি কখনোই বিশ্বাস করতেন না, এ দেশের মানুষ তাঁকে খুন করতে পারে। মানুষকে পাগলের মতো ভালোবেসে যাওয়া এমন মানুষকে নিয়ে লেখা তো সহজ।

এমন মানুষকে নিয়ে লেখা তো সহজ। যিনি লিখেন, ‘নীতিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশের সেবার চাইতে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৭৩

আরো লিখেছেন তিনি, ‘পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয় পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারা বিষাক্ত করে তুলেছে। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেয়া তারা দরকার মনে করল না।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৪১

তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ শুধু কিছু বেইমান-বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারা জীবন দুঃখ ভোগ করল। পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার লোকের অভাব হলো না। যারা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দিয়ে যাচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার আত্মরক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব নেই। এই সুজলা সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর- এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে সেই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা। কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১১২

একমাত্র তিনি লিখতে পারেন, ‘ভাত-কাপড় পাওয়ার ও আদায় করে নেয়ার অধিকার মানুষের থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধহয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’ আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা-১১৯

রাজনীতি নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে, ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে এমন কঠিন ও বাস্তব আত্মচিন্তা যাঁর, তিনি তো একজনই- এই বাংলার মাটি ও আবহে তৈরি এক মানুষ, যাঁর একমাত্র স্বপ্ন ছিল বাংলা ও বাংলার মানুষের কল্যাণ- শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির পিতা। তাই তিনি তো এখনো আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে শত শত কোটি মানুষের হৃদয়ে। তাঁকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস না থাকলেও তাঁকে শত কোটি শ্রদ্ধা তো জানাতেই পারি। সেই ক্ষুদ্র চেষ্টাটি না হয় শততম জন্মবার্ষিকীতে করলাম।

বাংলা ট্রিবিউন -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top