চাপ সামলে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

S M Ashraful Azom
0
চাপ সামলে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি


সেবা ডেস্ক: বাঙালি বীরের জাতি। বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা বাঙালির অসীম। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই দেখে এ ক্ষমতার আঁচ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিরও একটি অন্তর্নিহিত শক্তি তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণে পুরো বিশ্ব যখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দুর্যোগের মধ্যে, তখন অর্থনীতির সেই শক্তি কাজে লাগছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর যেসব আঘাত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, অল্প সময়ের মধ্যে তার অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে অর্থনীতি। তবে কিছু খাত এখনও করোনা-পূর্ববর্তী ধারায় ফেরেনি। করোনা নতুন কিছু ঝুঁকিও তৈরি করেছে। অবশ্য পৃথিবীর কোনো দেশের অর্থনীতিই এখন ফুরফুরে অবস্থায় নেই।
চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে সংক্রমণের কারণে এ বছরের প্রথম থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় এপ্রিল থেকে। ওই মাসে রপ্তানি কমে যায় ৮৩ শতাংশ। রেমিট্যান্সও বেশ কমে যায়। সরকার সাধারণ ছুটির আদলে লকডাউন ঘোষণা করলে শিল্প ও সেবা খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে। শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে যায় এবং বড় অঙ্কের মানুষ অভাবে পড়ে। এ অবস্থায় সরকার এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর সঙ্গে রাজস্ব ও আর্থিক নীতির মাধ্যমে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো হয়। এর সঙ্গে কৃষক, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা টিকে থাকার লড়াই শুরু করেন। সাধারণ ছুটি ছিল প্রায় দুই মাস, যার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা চলে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অর্থনীতিতে মোটামুটি গতি ফিরে আসে। জুন থেকেই অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে স্বস্তি দেখা যায়।
করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমলেও এখনও শেষ হয়নি। ফলে এর প্রভাবে দেশের এবং বিশ্বের অর্থনীতি ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার ওপর শক্ত অনুমান করা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত এবং পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকের চেয়ে এগিয়ে বলা যায়। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক বড় পূর্বাভাস রয়েছে আইএমএফের। এ মাসে প্রকাশিত সংস্থাটির ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার বাড়বে। বাকি দেশগুলোর অর্থনীতি বাড়বে না, সংকোচন হবে। যাদের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে এবং প্রবৃদ্ধির বিচারে শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে থাকবে। অবশ্য বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে চলতি পঞ্জিকাবর্ষ ধরে পূর্বাভাস দিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা জুলাই-জুন অর্থবছরভিত্তিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের পূর্বাভাস বলতে গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত বুঝতে হবে। আইএমএফ বলেছে, এ সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে।
পঞ্জিকা বা অর্থবছরের হিসাব বা পূর্বাভাসের মধ্যে তুলনার আলোচনার বাইরে গিয়ে বলা যায়, দেশের ও আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাই বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকোচনের কোনো পূর্বাভাস দেয়নি। বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিলেও তাদের বৈশ্বিক পর্যালোচনায়ও অনেক দেশের জিডিপি কমে যাওয়ার অনুমান রয়েছে। অপর আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা এডিবি বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। এডিবি বলেছে, এ দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরু হয়ে গেছে এবং অনেকের তুলনায় এ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তি নিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ আলোচনা বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপির ওপর আইএমএফের পূর্বাভাস নিয়ে। আইএমএফ মনে করছে, ২০২০ সাল শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে ১৮৮৮ ডলার হবে। ভারতের ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে হবে ১৮৭৭ ডলার। এই পূর্বাভাসের মূল কারণ হলো, এ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হবে। অন্যদিকে ভারতে সংকোচন হবে। শুধু ভারত নয়- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানিসহ বিশ্বের প্রায় সব বড় অর্থনীতিতে এবার সংকোচন হবে। করোনার প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া মন্দা ১৯৩০ সালের মহামন্দার চেয়েও ভয়াবহ হবে বলে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে।
পরিসংখ্যান কী বলে :করোনার প্রভাবে গত এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম। জুনে এসে পরিস্থিতির লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়। ওই মাসে ১৮৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে এবং প্রবৃদ্ধি হয় ৩৪ শতাংশ। জুলাই মাসে রেকর্ড ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে এবং ৬৩ শতাংশ বাড়ে। আগস্টে বাড়ে ৩৬ শতাংশ। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। পণ্য রপ্তানিতে এপ্রিলে বড় ধরনের ধস নেমে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের আয় হয়। আগের বছরের একই মাসের চেয়ে যা ৮৩ শতাংশ কম। জুলাই মাসে এসে ৩৯১ কোটি ডলারের রপ্তানি হয় এবং ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে এবং আগস্টে ও সেপ্টেম্বরে তা বহাল রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৯৯০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা উন্নতির পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। জুলাইতে বেসরকারি খাতে এক বছর আগের তুলনায় ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। আগস্টে বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের গতি ধীর ছিল। জুন পর্যন্ত কয়েক মাস এই প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের কম ছিল। জুলাই ও আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে এসে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিন মাসে রাজস্ব আয় বেড়েছে ৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নও বেড়েছে। করোনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তি দেখিয়েছে কৃষি খাত। এর কারণ, লকডাউনের মধ্যে কৃষি উৎপাদন তেমন বাধাগ্রস্ত হয়নি। এবার বোরোর উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি টনের বেশি। গমের উৎপাদন বেড়েছে ৯ শতাংশ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। যথাসময়ে উপকরণ প্রাপ্তি, কম সুদে কৃষিঋণসহ সরকারের নানা সহায়তা করোনার মধ্যে কৃষি উৎপাদন ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।
ঝুঁকি কোথায় :করোনার কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্কলন বলছে, গত জুন শেষে অতিদারিদ্র্যের হার এক বছর আগের ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার জরিপে ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের উদ্যোক্তা এবং শ্রমজীবী মানুষের সংকটের কথাই বেশি আসছে। কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া আর্থিক খাতের ঝুঁকিও বেড়েছে। এ খাতের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজের বেশিরভাগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এবং একই সঙ্গে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার কারণে আগামীতে খেলাপি ঋণ বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। চাল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষকে ভোগাচ্ছে। আগামীতে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার। এদিকে শীতকালে করোনার সংক্রমণ বাড়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা যদি সত্যি হয় তাহলে অর্থনীতির এখনকার স্বস্তির জায়গাগুলো বিশেষত রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। কারণ, বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর রপ্তানি ও রেমিট্যান্স অনেকটাই নির্ভর করে।

বিশেষজ্ঞ মত :বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চলতি অর্থবছরের তিন মাসের যেসব উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স যে কারণেই আসুক, রীতিমতো চমক দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি বাজারের নতুন পণ্য যেমন- মাস্ক, পিপিপি, অ্যাপ্রোন ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সুযোগ নিতে পেরেছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের উন্নতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে এখন প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য। এর কারণে এমনিতেই সুদের হার কমে এসেছে।
ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ অবস্থায় সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান বাড়াতে পারলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে। কম অগ্রাধিকারের প্রকল্পের কাজ স্থগিত রেখে জনগুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করতে পারলে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কভিডের মধ্যে টিকে থাকার বড় কারণ গ্রামীণ অর্থনীতি। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বিপণন ব্যবস্থা যাতে মার না খায়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রায় তিন কোটি লোক জড়িত। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, কভিডের আগের ও পরের অর্থনীতির মধ্যে অনেক পার্থক্য হবে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও ডিজিটাল হবে, যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জোর প্রচেষ্টা দরকার হবে।

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top