বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের পরিবেশ হোক দূষণমুক্ত

S M Ashraful Azom
0
বিশ্ব পরিবেশ দিবস  আমাদের পরিবেশ হোক দূষণমুক্ত



আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার পরিবেশ দিবসের থিম হচ্ছে- “Ecosystem Restoration” অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। বৈশ্বিক মহামরি করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কারণে এবার পরিবেশ দিবস তেমন আড়ম্বের সাথে পালিত হবে না। তারপরও বিভিন্ন মাধ্যমে আওয়াজ উঠেছে পরিবেশ দূষণ রোধ এবং আমাদের করণীয় নিয়ে। আমরা এখন অনেক সচেতন হয়েছি। করোনা আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণ ও এর পুনরুদ্ধারের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে। পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য প্রকৃত অর্থে যুগোপযোগী। কারণ পরিবেশ দিন দিন দূষিত হচ্ছে। ফলে আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের বিপরীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাই এখনই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে।

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের পরিবেশ। আর পরিবেশের মধ্যে যা কিছু থাকে তাদের বলা হয় পরিবেশের উপাদান। উপাদানের মধ্যে রয়েছে গাছপালা, ঘরবাড়ি, পশু-পাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত এবং আরও অনেক কিছু। এসব উপাদান মানুষ ও অন্যান্য জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলোর ক্ষতি হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। 

পরিবেশের সকল উপাদান আমাদের পরিবেশকে যেমন সুন্দর করে, আবার দূষিতও করতে পারে। প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশে একদিন জীবন সম্ভব হয়েছিল এ পৃথিবীর বুকে। বনাঞ্চলের পরিমাণ বেশি এবং জনসংখ্যা কম থাকায় বায়ুমন্ডলে আমাদের তথা সমস্ত জীবকূলের বন্ধু অক্সিজেনের অভাব ছিল না। খাদ্য ও জলে ছিল সতেজ বিশুদ্ধতা। কিন্তু জীবনকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান যখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করল, অমনি পরিবেশ আর আগের মতো রইল না। বিজ্ঞানের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীতে ডেকে আনা হলো অতি যান্ত্রিকতা। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে তার যে সাম্যাবস্থা দীর্ঘকাল ধরে বজায় ছিল, তা ধীরে ধীরে বিঘ্নিত হতে শুরু করল। দূষিত হতে শুরু করল পরিবেশ। আজ এই পরিবেশ দূষণে সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। বায়ুমন্ডলে আগের মতো আজ বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া খুবই কষ্টকর। পরিবেশ দিতে পারছে না জীবজগতের নিরাপত্তা। নির্বিচারে প্রকৃতি সংহার এবং কান্ডজ্ঞানহীন আবহাওয়া দূষিতকরণের মধ্য দিয়ে মানুষ পৃথিবীতে ডেকে এনেছে ক্ষয় ও অবক্ষয়ের  মহামারি। বাংলাদেশেও একই অবস্থা বিরাজমান। 

বিজ্ঞানী কলিন ওয়াকারের মতে রাসায়নিক, ভৌতিক ও জৈবিক কারণে পরিবেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে ও যেকোন পরিবর্তনই হলো দূষণ। ইউনেস্কো Earth summit & International Relation -এর দৃষ্টিতে পৃথিবী নামক গ্রহের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা যা আমাদের সামাজিক, অর্থনেতিক, রাজনৈতিক জীবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে তাকে পরিবেশ দূষণ বলা হয়। 

পরিবেশ দূষণ বর্তমান বিশ্বে একটি বড় সমস্যা। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণ করছি। পরিবেশ আমাদের জীবন রক্ষাকারী বললে ভুল হবে না। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই আমরা পরিবেশ থেকে গ্রহণ করে থাকি। প্রতি সেকেন্ডে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা পরিবেশের উপাদান গাছ থেকেই পায়। প্রতিনিয়ত আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা পরিবেশের দান। কিন্তু মানুষ নিজের জীবনকে শান্তিতে পার করার উদ্দেশ্যে বন কেটে বাড়ি নির্মাণ, গাড়ি তৈরি, সড়ক নির্মাণ করছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি বয়ে আনছে। আমাদের জীবনযাত্রায় আজ একদিকে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরব, অন্যদিকে দূষণের দুঃস্বপ্ন। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণের মতো ক্ষতিকর প্রভাব এখন আমাদের নিত্য সঙ্গি। 

পরিবেশ দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বায়ু দূষণ। বায়ুতে সাধারণত শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন, ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.০৩১ ভাগ কার্বন ডাইঅক্সাইড, একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে ওজন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। যদি কোন কারণে বায়ুতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় অথবা বালিকণার ভাগ বৃদ্ধি পায় তবে বায়ু দূষিত হয়। বায়ু দূষণ গত এক শতাব্দী হতে শহর ও শিল্প এলাকার কোটি কোটি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রাচীনকালে যখন আগুন আবিষ্কৃত হলো, তখন থেকেই বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান অক্সিজেনের ধ্বংসলীলা সূচিত হয়। আগুন বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করে জীবনের অনুকূল পরিবেশের ভারসাম্যই শুধু নষ্ট করে না, ধোয়া এবং ভস্মকণায় তাকে করে তুলেছে কলুষিত। গাছপালা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে প্রাণীর জন্য অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয় এ পৃথিবীতে। কিন্তু মানুষ নগর জনপদ গড়ে তোলার প্রয়োজনে বিরামহীনভাবে কঠোর হাতে তুলে নেয় নিষ্ঠুর কুঠার। ফলে অক্সিজেনের উৎপাদক দুঃখ প্রকাশ করে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করে। কিন্তু মানুষের মায়ার হাত একটুও প্রসারিত হয় না বৃক্ষের প্রতি।

যানবাহনও বায়ু তথা পরিবেশকে নানাভাবে দূষিত করে। গাড়ি যখন চলে তখন অক্সিজেনের সাথে কার্বনের দহন শক্তি উৎপন্ন হয়। দহনকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের সঙ্গে আরও কতগুলো গ্যাস নির্গত হয়ে থাকে। নির্গত গ্যাসগুলোর মধ্যে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসও থাকে। কলকারখানার ক্ষেত্রে যে দূষিত পদার্থ কালো চুল্লী দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বাতাসকে বিষাক্ত করে তোলে, তার পরিণতির কথা ভাবলে যেকোন সুস্থ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন।

বায়ু দূষণ প্রসঙ্গে আর একটি দিকের কথা উল্লেখ করা যায়। তা হলো ধোঁয়াশা। ধোয়া আর কুয়াশা অবলম্বন করে এর উৎপত্তি। শীতের সন্ধ্যায় স্তব্ধ আবহাওয়ায় ধোঁয়াশার উৎপত্তি ঘটে এবং এর অস্তিত্ব শহর ও শহরতলীর পরিমন্ডলে অধিক মাত্রায় রয়েছে। শীতকালে ঠান্ডা হাওয়ায় বাতাসের জলীয়বাষ্পের ঘনীভূত রুপ বাতাসের ধুলিকনা ও কার্বনের কণাকে অবলম্বন করে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। যে বাতাসে আমরা শ্বাস গ্রহণ করি, সেই বাতাসই যদি দূষিত হয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। আজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মাথাধরা, শ্বাসরোগ, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ যে ক্রমবর্ধমান, তার মূল কারণ বায়ু দূষণের মত্রা বৃদ্ধি। গ্রামের মানুষও আজ বায়ু দূষণ থেকে মুক্ত নয়।

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু এই পানি আজ দূষিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। কোন জলাশয়ে শিল্পজাত বা গৃহস্থলির বর্জ্য পদার্থ পানিতে বিগলিত হয়ে বা ভাসমান থেকে অথবা তলায় জমে থেকে জলজ বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ব্যাঘাত ঘটালে তখন আমরা একে পানি দূষণ বলে থাকি। দূষিত পানি মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যবহারের ফলে অবস্থানগত পরিবর্তিত হয়ে পড়ে, ফলে ঐ পানি যে সব উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতো এখন তা করা যায় না। ভূমÐলের শতকরা ৭০ ভাগ পানি দ্বরা আবৃত। সাগর, নদী, বিল, হ্রদ ইত্যাদির পানি বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পানি যদি কোন কারণে দূষিত হয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। নদীনালা, খালবিলের পানিতে কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য এবং শহর ও গ্রামের পয়োবর্জ্য মিশে পানি দূষিত করছে। শস্যক্ষেতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গিয়ে পানিতে মিশে পানি দূষিত করে। দূষিত পানিতে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণি বাস করতে পারে না। জলজ উদ্ভিদও জন্মায় না। দূষিত পানি ডায়রিয়া, জন্ডিস, পাঁচড়া, টাইফয়েড ইত্যাদি নানা রকমের রোগ ছড়ায়। দূষিত পানি রান্না, ধোয়ামোছা, গৃহস্থলি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যায় না। এ পানিতে গোসল করলে চুলকানি, খুঁজলি পঁচড়া ইত্যাদি নানা রকমের চর্মরোগ হয়।

পানি যদি কোন কারণে দূষিত হয়ে পড়ে , তাহলে আমাদের জীবন সঙ্কটময় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর তীরে অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠেছে। শিল্প উৎপাদনে নিয়োজিত বিভিন্ন কারখানায় নানারকম রাসায়নিক ও বর্জ্য বস্তু নিয়মিতভাবে নদীগর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীগর্ভে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ নদীর পানিকে কতটা দূষিত করে, সঠিক বিচারে তা বলা কঠিন। তার উপরে গৃহের উচ্ছিষ্ট এবং পৌর কর্পোরেশনের আবর্জনা সেই দূষণ ক্রিয়াকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। লঞ্চ-জাহাজ থেকে নির্গত তেলও পানি দূষণের একটি অন্যতম কারণ। শধু নদীর পানি নয়, গ্রামের পুকুর, খাল-বিলের পানিও নানা করণে দূষিত হয়। নালা-নর্দমার সঙ্গে পুকুরের যোগ আছে। তাছাড়া বাড়ি-ঘর এবং বিবিধ আবর্জনার শেষ আশ্রয়স্থল বিভিন্ন জলাশয়। ফলে, জলাশয়ের পানি যেখনে পানীয় জলের অবলম্বন, সেখানে জনস্বাস্থ্যের অবনতি ঘটার গুরুতর আশঙ্কা আছে। পনি দূষণ আধুনিক সভ্যতার এক অভিশাপ। গ্রামে নদীর পানিতে, পুকুরে প্রচুর আবর্জনা ফেলা হয়, পাট পঁচানো হয় ফলে পানি দূষিত হয়। 

বায়ু ও পানি দূষণের সাথে সাথে শব্দ দূষণের কথাও উল্লেখ করার মতো। গ্রামে কম হলেও শহরে এ দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় বাস, ট্রাক, ট্যাক্সির হর্ন, কলকারখানার আওয়াজ, বোমাবাজি, মাইকের চিৎকার, মিছিলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি এসবই স্বাভাবিক পরিবেশকে নষ্ট করে আমাদের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিঘিœত করছে।

বাতাস-পানি দূষণ নিয়ে আমাদের মাথা তীব্র ব্যথা করে। পরিবেশ দূষণ নিয়ে বক্তৃতা-সেমিনার দেশ-বিদেশে কম হচ্ছে না। কিন্তু পরিবেশকে নিজের আয়ত্তে আনতে পেরেছি কি? জবাব আসবে খুবই ছোট্ট। আর তা হচ্ছে পারিনি। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রী, শিশু-কিশোর, কিংবা কচি-কাচা সকলের কাছে শব্দ দূষণকেও পরিবেশ কিংবা ব্যক্তি জীবনের কষ্টদায়ক ফল বলে মনে হচ্ছে। বাসস্ট্যান্ড, মাঠ-ঘাট এমনকি স্কুলের পাশেও উচ্চস্বরে মাইক বাজছে, যার তীব্রতা অনেক বেশি। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে ৫০ ডেসিবেলের উপর শব্দের তীব্রতা সৃষ্টি হলে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগরীতে এর মাত্রা ৫০ ডেসিবেলের অনেক উপরে। শহর বাদেও গ্রামে এখন মেলা, যাত্রা, গানের জলসা নামক অনুষ্ঠানে অহরহ শব্দ দূষণ হচ্ছে। ক্যাসেট-সিডি, মাইকের দোকানে দিনের অধিকাংশ সময় উচ্চমাত্রায় গান বাজে। এতে স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখায় দিনে দিনে মনযোগ হারাচ্ছে। মায়ের গর্ভে থাকা শিশুরা জন্মের পর বিভিন্ন বিকৃত আচরণ করছে। শুধু তাই নয়, শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগ, মাথা ব্যথা, বধিরতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে পারমানবিক যুগ। কাঠ, কয়লা এবং তেল দহনের ফলে বায়ুমÐল যে পরিমাণে দূষিত হয়, পারমানবিক দহনে দূষণের পরিমাণ তার চেয়ে কয়েক লাখ গুণ বেশি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অন্তিম বর্ষে পারমানবিক বোমা বর্ষণের ফলে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকিই ধ্বংস হয়নি, তার প্রবল প্রতিক্রিয়ায় সন্নিহিত ভূখন্ডের মানুষ, জীবজন্তু এবং উদ্ভিদের সুস্থ অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই বিষময় পরিণামের কথা স্মরণ রেখেও পৃথিবীর ঘরে ঘরে এখনও চলছে পারমানবিক বোমার প্রস্তুতি। পরীক্ষামূলকভাবে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে বায়ুমÐলকে যে পরিমাণে বিষাক্ত করে তোলা হয়, বায়ুমÐলকে সেই পরিমাণ বিষমুক্ত করে তার পরিশোধনের বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেই। তাছাড়া প্রচÐ শক্তিশালী রকেটের সাহায্যে মহাকাশ অভিযানেও উপগ্রহ উৎক্ষেপণে যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমÐলে নিক্ষেপ করা হয়, তাতেও আবহাওয়া দূষিত করে চলেছে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো।

আমরা প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ব্যবহার করছি। কিন্তু এ পলিথিন ও প্লাস্টিক মাটিতে পঁচে না। তাই এগুলো মাটি বা পানির সঙ্গে মিশে যায় না। মাটিতে পলিথিন বছরের পর বছর অবিকৃত অবস্থায় থাকে। এরুপ মাটিতে গাছপালা ভালভাবে জন্মায় না। মাটির নিচে পলিথিন অথবা প্লাস্টিক থাকার কারণে উদ্ভিদের মূল মাটির গভীরে যেতে পারে না। এতে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এটা এক ধরণের মাটি দুষণ। পলিথিন ও প্লাস্টিক ছাড়া কলকারখানার বিভিন্ন বর্জ্য মাটিতে জমে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে এবং একে দুষিত করে। দুষিত মাটিতে কোন গাছপালা জন্মায় না। চাষাবাদ করে ফসল ফলানো যায় না। ভালো ফসল ফলানোর জন্য এবং কীট-পতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকেরা অপরিকল্পিতভাবে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে মাটি দূষণের সাথে সাথে জীবজগতে বিপন্ন অবস্থা দেখা দিয়েছে। 

আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে আমাদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব। নাগরিকের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকার পরিবেশ সুন্দর রাখাও আমাদের দায়িত্ব। সরকার পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন ধরণের আইন প্রণয়ন করেছে। গ্রহণ করেছে বিভিন্ন ধরণের কর্মকাÐ। যেমন- ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অতিথি পাখি ধরা ও শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ। পাহাড় কাটা ও জলাভূমি ভরাট ইত্যাদি বেআইনি কাজ। নাগরিক হিসেবে এ সকল আইন মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। সমাজের অন্যরাও যেন সকল আইন মেনে চলে সে বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। এছাড়া সরকার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, রাস্তাঘাট পরিষ্কারের মতো যে সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নেয় সেখানে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য চাই সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করছে। তাই সচেতন করে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধকল্পে প্রতিবছর ৫ জুন জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু তা বক্তৃতা-সেমিনার ঘেরা এক নি®প্রাণ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিশ্বের জ্ঞানপাপীর দল বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে, দূষণের জন্য চোখের পানিও ফেলে, আর সাহসীকতার সাথে আবার পরিবেশ দূষিত হয় এমন কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। 

পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশের ভূমিকা একবারেই নগন্য। আর পাশ্চাত্যেও শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রায় ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে বাংলাদেশ তার সমুদ্র তীরবর্তী নিচু অংশ হারাবে বলে বিজ্ঞানীরা বলেছেন। অন্য দেশ পরিবেশ দূষণ করবে আর আমাদের মতো সুন্দর পরিবেশ তৈরিতে সহায়তাকারী দেশ এর মারাত্মক ক্ষতিকর ফল ভোগ করবে, তা হতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের মন্ত্রি-আমলাদেরকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিজেদের দাবি পেশ করতে হবে। তাঁরা যেন পরিবেশ দূষণের কাজ না করে সে বিষয়ে অবহিত করতে হবে। অতীতে বাংলাদেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে।   

যানবাহন থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থযুক্ত কালো ধোঁয়া যাতে বন্ধ করা যায়, তার জন্য পুরোনো ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করা দরকার। ধূমপায়ীদের বিরুদ্ধে যে নীতিমালা রয়েছে, তার বাস্তবায়নও জরুরী। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর মনোভাব দেখাতে হবে। কলকারখানা বা ইটের ভাটাগুলো শহর বা জনবসতির কাছাকাছি না হওয়া বাঞ্চনীয়। অপরিকল্পিতভাবে জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার থেকে কৃষকরা বিরত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরী। জৈব আবর্জনা না পুড়িয়ে পঁচানোর মাধ্যমে সারে পরিণত করা যায়, তা কৃষকদেরকে বুঝাতে হবে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণও খুব কঠিন কাজ নয়। হর্ন ও মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশষ করে স্কুলের পাশে যেন হর্ন, মাইক বাজানো না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। রাস্তার পাশে যেন স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ করা না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। 

সাস্থ্যসম্মত বসবাস করতে হলে দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে পরিবেশ দূষিত করে এমন কর্মকান্ত থেকে বিরত থাকতে হবে। দূষণ প্রতিরোধের জন্য জনবসতি ও সভ্যতার স¤প্রসারণের প্রয়োজনে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। অরণ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলেও, যেখানে সুযোগ আছে, সেখানেই গাছ লাগাতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য যাতে পরিবেশ দূষিত না করে সে জন্য বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধের জন্য গাছপালার প্রতি যতœশীল হতে হবে। বাড়ির আশেপাশে গাছপালা লাগাতে হবে। বনায়নের পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কর্মকান্ডে অংশ নিতে হবে। গাছের যতœ এবং অপ্রয়োজনে গাছপালা কাটতে জনগনকে নিষেধ করতে হবে। 

আমাদেরকে বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে- ‘আজ আর পরিবেশ দূষণ নয়, চাই তার বিশুদ্ধকরণ।’ আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাস উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। আগামীর প্রজন্ম যেন আমাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তার ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। পরিবেশ দূষিত হয়, এমন সকল কাজ থেকে দূরে থাকা এবং উপকারী সকল কাজ আরও বৃদ্ধি করা আমাদেরই দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালন না করলে পরিবেশ দূষণজনিত অপমৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাই আমাদের শ্লোগান হোক- Live and let live.  অর্থাৎ, বাঁচো এবং বাঁচতে দাও।


লেখক: 
শাহাদাত আনসারী
[ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক]
 


শেয়ার করুন

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top