রয়টার্স প্রতিবেদন: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাতে হবে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন তিনি। সেনাপ্রধান জানান, সেনাবাহিনী পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করবে এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখতে চান। সেনাবাহিনী দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং সেনাপ্রধান ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে তার কার্যালয়ে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের সময়। ছবি: REUTERS |
- শেখ হাসিনার পদত্যাগ: ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা
- গণতন্ত্রে উত্তরণ: দেড় বছরের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা
- বিক্ষোভ, দমন-পীড়ন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন
- সেনাবাহিনীর রাজনীতি থেকে দূরত্ব ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার অঙ্গীকার
- মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশে গণতন্ত্রের পূর্ণ উত্তরণ ঘটাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ভারতে তার পালিয়ে যাওয়ার পর, বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার এই সরকারকে ‘যাই হোক না কেন’ পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন।
"আমাদের বর্তমান অবস্থায় ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা অপরিহার্য, যাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করা যায় এবং আগামী ১৮ মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়।"
— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, "আমাদের বর্তমান অবস্থায় ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা অপরিহার্য, যাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করা যায় এবং আগামী ১৮ মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়।"
শেখ হাসিনার পদত্যাগ: ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা
গত আগস্ট মাসের শুরুতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর পদত্যাগ করেন এবং প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান। সেনাবাহিনী তখন কোনো হস্তক্ষেপ করেনি, ফলে পরিস্থিতি দ্রুত হাসিনার পতনের দিকে গড়ায়। সেনাপ্রধান ওয়াকার এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা বজায় রাখার উপর জোর দেন এবং বলেন, "আমি ড. ইউনূসের পাশে আছি এবং যাই হোক না কেন, তার মিশন সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করব।"
"যাই হোক না কেন, আমি ড. ইউনূসের পাশে থাকব, যাতে তিনি তার মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারেন।"
— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
ড. ইউনূস, যিনি নোবেল বিজয়ী এবং ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত, বর্তমানে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করবেন।
গণতন্ত্রে উত্তরণ: দেড় বছরের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশা
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, "সংস্কার শেষ করে এক বছরের মধ্যে বা সর্বোচ্চ দেড় বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত। তবে এই সময়ের মধ্যে ধৈর্য বজায় রাখাটাও জরুরি।" তিনি আরও বলেন, "যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি, তবে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।"
"গণতন্ত্রে উত্তরণ আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে করা উচিত, তবে এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে।"
— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তিনি এবং ড. ইউনূস বৈঠকে মিলিত হন এবং বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরামর্শ বিনিময় করেন।
বিক্ষোভ, দমন-পীড়ন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন
গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে সরকার ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। এতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। এই সহিংসতা পরবর্তীতে সরকারবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পরিণত হয়।
"সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিকের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।"
— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
তবে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছে। যদিও সিভিল সার্ভিসের কিছু বিভাগ এখনো সম্পূর্ণ কার্যকর হয়নি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বাহিনী এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
সেনাবাহিনী বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেনাপ্রধান জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার সদস্য রয়েছে এবং তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী।
সেনাবাহিনীর রাজনীতি থেকে দূরত্ব ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার অঙ্গীকার
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, "বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করবে। আমি এমন কিছু করব না যা আমার বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর।" তিনি জানান, সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য অতীতে অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগের ভিত্তিতে শাস্তি পেয়েছেন এবং সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে এমন কোনো অনিয়ম বরদাশত করবে না।
তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘ মেয়াদে, সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা উচিত। সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে সরাসরি রাখা যেতে পারে, যাতে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।"
মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক গুম হওয়া প্রায় ৬০০ জনের বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেনাপ্রধান বলেন, তিনি সেনাবাহিনীকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে চান।
"আমি এমন কিছু করব না যা আমার সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষতিকর হবে। আমি আমার বাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।"
— সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
তিনি বলেন, "সেনাবাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিকের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয়।"
এটা স্পষ্ট যে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার দায়িত্বকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পেশাদার এবং নিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।