![]() |
স্বাধীন বাংলা বেতারের ১ম কণ্ঠশিল্পী শাহ আলী সরকার |
যার অতীত সমৃদ্ধ অসীম আর বর্তমান-ভবিষ্যৎ অন্ধকারের আস্তাবলে ঘূর্নায়মান -স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনিই প্রথম কন্ঠযোদ্ধা শাহ আলী সরকার। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলাধীন ঢেকুরিয়া গ্রামে ১৯৪৭ সালে শাহ আলী সরকার জন্ম গ্রহন করেন। গ্রামের স্কুলে ৫ম শ্রেণীর পাঠশেষে চলে যান রংপুরে। সেখানকার কালীগঞ্জ উপজেলার কুমড়ির হাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন। যোগ দেন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে রংপুর বেতারে।
১৯৭১ এর উত্তাল মার্চ। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার অগ্রিমন্ত্রে উজ্জীবিত। শাহ আলী সরকার ২৫ মার্চের পর রংপুরের ভুরুঙ্গামারী মুক্তিকাম্পে যোগ দেন। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সেখানে প্রশিক্ষণ ও অপারেশনে অংশ গ্রহন করেন। এসময় নবগঠিত অস্থায়ী সরকার সিদ্ধান্ত নেন পাকবাহিনীর নৃশংসতার ইতিহাস বহিঃবিশ্বে তুলে ধরতে হবে। সেই সাথে মুক্তিবাহিনীর জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে শাহ আলী সরকার কোলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত হন। পাড়ি জমান কোলকাতা। ২৬ মে নিজের লেখা ও সুরে- তোরা কোথায় রে বাংলা ভাষী/ মুক্তিযুদ্ধে চলো যাই; এর পর, আরেও বাঙ্গালীরে/ দুশমনেরে দেশে রাইখো না’ ইত্যাদি গান পরিবেশন করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনিই প্রথম কন্ঠশিল্পী।
এরপর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তহবিল সংগ্রহ ও বহিঃবিশ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকান্ড তুলে ধরতে একটি সাংস্কৃতিক দল গঠন করা হয়। সেখানে এদেশের পক্ষে অংশ নেন প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মোশাদ আলী ও শাহ আলী সরকার। ভারতীয়দের মধ্যে ছিলেন রমাগুহ ঠাকুরতা, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সবিতাব্রত দত্ত, রাধাকান্ত, ফনী ভূষণ ভট্রাচার্য ও চন্দ্রকান্ত নন্দী। এই সঙ্গীত দল ৭ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহিঃবিশ্বের নানাস্থানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাদের সাথে বহু বিদেশি শিল্পীও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৪ নভেম্বর লন্ডনের রোজ বেরী এভিনিউ, ইসি ওয়ান, এ এক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শাহ আলী সরকার সম্পর্কে পরিচিতি পত্রে উলে¬খ করা হয়- ÔShah Ali Sarkar is popularly known as ‘palli kobi’ (peoples poet and singer) in
২৭ নভেম্বর ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিবিসিতে বাইশটি দেশের সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পক্ষে স্বাক্ষাতকার দেন শাহ আলী সরকার।
দেশ স্বাধীন হবার পর শাহ আলী সরকার রংপুরে বেতার থেকে ঢাকা বেতারে চলে আসেন। এরপর থেকে শুরু হয় শাহ আলী সরকারের ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনের সামনে এগিয়ে চলা। স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে অসহযোগিতার কারনে বেশ কিছু নামিদামি শিল্পীকে ঢাকা বেতার থেকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। শাহ আলী সরকার মানবিক কারণে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে তৎকালীন বেতারের কর্ণধার শামসুল হুদা চৌধুরীর সঙ্গে তার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে শাহ আলী সরকারকেই বেতার থেকে বহিস্কার করা হয়। রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে ফিরে আসেন রংপুরে। কিন্তু সেখানেও তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি।
ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনের শুরু এভাবেই হলো। বেকার টগবগে শাহ আলী সরকার এসময় দেশের বিভিন্ন মাজার, দরবার, সন্ন্যাসীর আখড়া, তরিকার জলসা প্রভৃতি স্থানে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে সংসারের সঙ্গে তার সব সম্পর্ক চুকে যায়। এসময় তারই সহ শিল্পীরা বিভিন্ন স্বাক্ষাৎকারে, কলামে, বক্তৃতায়, অনুষ্ঠানে বলতে থাকেন, স্বাধীনতার পরই মস্তিস্ক বিকৃত হয়ে শাহ আলী সরকার মারা গেছেন। মৃত্যুর চাঁদরে ঢেকে ফেলার এমন প্রয়াসে বিস্মিত হন তিনি। কিন্তু নিভৃতচারী, বিনয়ী এই কন্ঠযোদ্ধা একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করেননি। অর্র্থ, পদ, লোভ, মোহ কোন কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। এই দুঃস্থ কন্ঠযোদ্ধার জীবনকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে দারিদ্রতা। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এই ত্যাগী লোকটি দীর্ঘদিন কাজিপুরের ঢেকুরিয়া গ্রামের এক ঝুঁপড়ি ঘরে বাস করেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এটিএন নিউজ. চ্যানেল একাত্তর তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে। বিটিভি'তেও তার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে।
আমৃতু্যু সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে তিনি দেশপ্রেম, বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতার কথা তুলে ধরতেন। তিনি ধর্মীয় গোড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে থেকে মানুষকে অসাম্প্রদায়িক জীবন গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আজও তার অনেক অনুসারী রয়েছে। কাজিপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী, তরিকার জলসা, যমুনার চরাঞ্চলে কৃষাণ-কৃষাণির মাঝে দিনে বা রাতে আজও যেন শাহ আলী সরকারের কন্ঠে ভেসে আসে তোরা কোথায়গো বাংলাভাষী......।
⇘সংবাদদাতা: আবদুল জলিল
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।