‘মৃত্যু’র মিছিলে প্রেক্ষাগৃহ

S M Ashraful Azom
চরম ক্রান্তিকালে পতিত এখন চলচ্চিত্র প্রদর্শন শিল্প। বড় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের এই বড় মাধ্যমটি। মানহীন সিনেমা, অনুন্নত পরিবেশ, হল আধুনিকায়ন না হওয়া, হাতের মুঠোয় সিনেমা দেখার অপার সুযোগ প্রভৃতি কারণে প্রেক্ষাগৃহ (সিনেমা হল) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শকরা। ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহসমূহের ক্রমবিলুপ্তির এই কালে আশা জাগিয়েও গণমানুষের কাছাকাছি যেতে পারছে না হাল ফ্যাশনের সিনেপ্লেক্সগুলো। ব্যবসায়িক মন্দার আবর্তে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন এর মালিকরা। এখন কেবল হল ভাঙার প্রতিযোগিতা চলছে। তারা সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করছেন মাল্টিকমপ্লেক্স, শপিংমল, গার্মেন্ট কারখানা বা বেসরকারি হাসপাতাল।
 
২০১২ সালে সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণার পর প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক ও কলা-কুশলীদের মধ্যে আশা জেগেছিল; কিন্তু কোন ফল আসেনি। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ ঠেকানো যায়নি। হলগুলোকে বাঁচাতে ভারতীয় সিনেমা আমদানি করেও দর্শককে হলমুখী করা যায়নি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১২শ সিনেমা হল ছিল, তার মধ্যে নয়শর বেশি হল বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা তিন শতাধিকে নেমে এসেছে। দেশের প্রায় সব জেলা শহরেই ছিল সিনেমা হল। এখন বহু জেলায় আর হল নেই। দেড় কোটি মানুষের রাজধানী মেগাসিটি ঢাকায় প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ৩৩ থেকে কমে ঠেকেছে ১৮টিতে।
 
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে মূলত শুরু হয় সিনেমা হলের মন্দার দিন। স্যাটেলাইট টিভি, ইন্টারনেট আর পাইরেসি গ্রাস করে দর্শকদের। ভারতের ছবির হুবহু নকল, অশ্লীল আর মানহীন গল্প নির্মাণ দর্শকদের ক্রমাগত হল বিমুখ করতে থাকে। আর দর্শক না গেলে ছবি ব্যবসা সফল হয় না। হল চালানোর খরচও ওঠে না। এ যেন দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতোই। তখন এই বিনোদন ব্যবসার ঝাঁপ নামাতে থাকেন ব্যবসায়িরা। এক সময় সিনেমা হল ভাঙলে দর্শকদের ভিড় যেন মিছিলের রূপ পেত। আর গত তিন দশকে আক্ষরিক অর্থেই ‘মৃত্যু’র মিছিলে যোগ দিয়েছে দেশের অধিকাংশ নামি-দামি সিনেমা হল।
 
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ঢাকায় নির্মিত ‘পিকচার হাউজ’ বাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষাগৃহ, পরে যার নাম হয় ‘শাবিস্তান’। কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে হলটি। ১৯৬৪ সালে পোস্তগোলায় নির্মিত হয় তখনকার বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ সিনেমা হল ‘ডায়না’, যার আসন সংখ্যা ছিল ১২শ। কয়েক মাস আগে ডায়নারও ‘মৃত্যু’ হয়েছে।  ডায়নার পাশেই ছিল যমুনা। সেই যমুনা হল ২০১৩ সালে বন্ধ করে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে হাসপাতাল।  ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গুলিস্তান হল ভেঙে গড়ে উঠেছে গুলিস্তান মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা সিনেমা হল ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেট। ঢাকা সেনানিবাসের গ্যারিসন বন্ধ হয়েছে ২০১৩ সালে, ২০১২ সালে বন্ধ হয়েছে পর্বত, সঙ্গীতা ও ঢাকা সেনানিবাসের সাগরিকা। গত এক দশকেই বন্ধ হয়েছে রূপমহল, লায়ন, স্টার, বিউটি, নাজ ও অতিথি। নিভে গেছে তাজমহল, জ্যোতি ও মুন সিনেমা হলের রূপালী পর্দাও। ভাঙার পথে রয়েছে আজাদ ও মানসী। মধুমিতা, জোনাকী, পদ্মা ও সুরমাও ভাল নেই।
 
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শকদের নেতা মিঁয়া আলাউদ্দিন জানান, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও বন্ধ হয়ে গেছে ১৬/১৭টি প্রেক্ষাগৃহ। হারিয়ে গেছে অলংকার, লায়ন্স, সানাই, রঙ্গম, সাগরিকা, বনানী, খুরশিদ মহল, নূপুর, জলসা, গুলজার, উপহার, রিদম, উজালা, আকাশ, মেলোডি ও সিনেমা কর্ণফুলি। রাজশাহী মহানগরে বন্ধ হয়েছে উত্সব, স্মৃতি, বনানী, বর্ণালী ও কল্পনা। নগরবাসীর বিনোদনের জন্য টিকে আছে কেবল ‘উপহার’। এক সময় যশোরের পরিচিতি ছিলো সিনেমা হলের শহর হিসাবে। ছিল ২১টি সিনেমা হল। সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে- যশোরে মাত্র ৬টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যশোর শহরে মনিহার ও তসবির মহল। আর উপজেলা পর্যায়ে চালু রয়েছে সোহেলী, পূরবী, মধুমিতা ও ময়ূরী সিনেমা হল।
 
খুলনা মহানগরীতে সিনেমা হল ছিলো ১১টি। এখন আছে মাত্র ৪টি। ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পেয়েছিল খুলনার ‘উল্লাসিনী’ হলে। ঐতিহ্যবাহী এই হলটিও বন্ধ হয়েছে গেছে প্রায় ১০ বছর আগে। এটি এখন গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সোসাইটি সিনেমা হলে মাঝে-মধ্যে নাটক মঞ্চস্থ হয়। বন্ধের তালিকায় রয়েছে পিকচার প্যালেস, চিত্রালী, লিবার্টি, ঝিনুক ও বৈকালী। কোনো রকমে চলছে শঙ্খ সিনেমা। চালু রয়েছে সঙ্গীত, মিনাক্ষী ও জনতা সিনেমা হল। ডুমুরিয়া উপজেলার একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে আরো দুইটি সিনেমা হল। এগুলো হলো- নেত্রকোনা জেলা শহরের একমাত্র সিনেমা হল ‘হীরামন’ ও নাটোরের ‘সায়াবান’।
 
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, হল ব্যবসায়ে ধসের এই প্রেক্ষাপটে  চলতি শতকের শুরুতে ’মাল্টিপ্লেক্স মুভি থিয়েটার’-এর ধারণা বাংলাদেশের সিনেমার বাঁচার আশা জাগালেও সেই পথ বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। বসুন্ধরা শপিং মলে ২০০৪ সালে চালু হওয়া ’স্টার সিনেপ্লেক্স’ এখন রাজধানীর একশ্রেণীর তরুণদের অন্যতম পছন্দের বিনোদন কেন্দ্র। সম্প্রতি চালু হয়েছে যমুনা ফিউচার পার্কে ‘ব্লক বাস্টার’। এছাড়া পুরনো ‘শ্যামলী’ হল ভেঙে ‘শ্যামলী স্কয়ার’ শপিংমলের অংশ হিসেবে চালু হয়েছে ‘শ্যামলী সিনেমা’। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘লায়ন’ সিনেমা হল ২০০৫ সালে ভেঙে ফেলার পর এখন সেখানে বিপণি বিতান নির্মাণ করে ৩/৪টি হল করার পরিকল্পনা চলছে। আধুনিক এসব মুভি থিয়েটারে দর্শকদের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা থাকলেও যা দেখানো হয় তার বেশিরভাগই সরাসরি আমদানি করা বিদেশি সিনেমা। নির্দিষ্ট দর্শক শ্রেণির জন্য উচ্চ মূল্যের টিকিটের এসব মুভি থিয়েটারকে ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহের উত্তর প্রতিনিধি মানতে রাজি নন সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। মূলত ঢাকায় মাল্টিপ্লেক্স যে হলগুলো চলছে সেগুলো মার্কেটের সঙ্গে বিনোদন ব্যবস্থার অংশ। ঢাকার মাল্টিপ্লেক্স প্রেক্ষাগৃহগুলোতে টিকিটের দাম ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। আর পুরনো সিনেমা হলগুলোতে টিকিটের দাম ড্রেস সার্কেল ১০০ থেকে ১৮০ টাকা, রিয়ার স্টল ৫০ থেকে ৮০ টাকা এবং স্টল ২৫ থেকে ৪০ টাকা।
 
মিঁয়া আলাউদ্দিন বলেন, পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন সিনেমা হলের মালিকরা। ব্যবসায়িক মন্দার কারণেই একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন যে সিনেমাগুলো নির্মিত হচ্ছে সেগুলো দর্শকের আগ্রহ তৈরি করতে পারছে না। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে হলে বছরে অন্তত ২০টি ব্যবসা সফল সিনেমা থাকতে হয়। আমাদের দেশে বছরে ৫০-৬০টি সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে; কিন্তু সেগুলো দর্শক টানতে পারছে না। এ ধরনের সিনেমা দিয়ে মিলনায়তন পূর্ণ করা যায় না।
 
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গত দেড় দশকে দেশের কোথাও নতুন কোনো সিনেমা হল হয়নি। সারাদেশে এখন চালু আছে মাত্র ৩২২টি হল। সেগুলোও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। একাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজকের সাথে আলাপকালে তারা বলেছেন, প্রযোজকরা চাইলেই পরিচালককে দিয়ে ‘হিট ছবি’ নির্মাণ করিয়ে নিতে পারেন না। আসলে কারো কাছেই সিনেমা হিট করানোর কোনো নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। দর্শকদের হলে ফেরানোর জন্য কোন ফর্মুলা কাজে আসছে না। হল ভাঙাও ঠেকানো যাচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে কেউ নতুন করে সিনেমা প্রদর্শন ব্যবসায়ও আসছেন না।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top