বাংলাদেশে এই
প্রথম আবিষ্কৃত হলো বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার মতো
প্রত্নতাত্ত্বিক ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খননকাজে অংশ নেয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন। আবিষ্কৃত এই মন্দির তত্কালে
বরেন্দ্র অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মচর্চার ওপর পরবর্তীকালের হিন্দু শাসকদের
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও হস্তক্ষেপের সরাসরি নিদর্শন বলে ধারণা
করা হচ্ছে। খননকাজ আরও এগিয়ে গেলে এ থেকে আরও চমকপ্রদ তথ্য গবেষণা কাজকে
সমৃদ্ধ করবে।
এখানকার প্রাপ্তি এ কথা প্রমাণ করে যে, প্রাচীন বরেন্দ্রে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ ধীরে ধীরে ঘটছিল।
খননকারীরা
বলছেন, মন্দির দুটির নির্মাণকাল ৮ম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে কোনো এক সময়। এর
আগে বাংলাদেশে বৌদ্ধ স্তূপকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার উদাহরণ পাওয়া
গেলেও বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার নিদর্শন এটাই প্রথম
বলে দাবি করছেন তারা।
দিনাজপুরের
বোচাগঞ্জ উপজেলায় আবিষ্কৃত এ মন্দির সংলগ্ন স্থান থেকে প্রথমবারের মত
স্তূপের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ দিয়ে স্তূপ নির্মাণ
করার রীতি মৌর্য সম্রাট অশোক সর্বপ্রথম শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায়
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দাহ করা
দেহাবশেষের উপরে স্তূপ নির্মাণ করার রীতি চালু হয়।
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি দল
অধ্যাপক স্বাধীন সেন ও অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহসানের পরিচালনায় তিন
মাসেরও বেশি সময় ধরে খনন চালিয়ে আসছেন। দলটি একই উপজেলার মাহেরপুরে প্রায়
এক হাজার বছর পুরানো একটি হিন্দু মন্দির আবিষ্কার করে। সংস্কৃতি
মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই খনন চলছে। অধ্যাপক স্বাধীন সেন ‘ইত্তেফাক’কে
জানান, ২০১২ সাল থেকে তারা সেতাবগঞ্জ (বোচাগঞ্জ) এলাকায় আর্কিওলজিক্যাল
সার্ভে করছেন। এ সময় ১২৬টি আর্কিওলজিক্যাল সাইট শনাক্ত করা হয়। বোচাগঞ্জের
রণগাঁও ইউনিয়নের বাসুদেবপুর ওয়ার্ডের ‘ইটাকুড়া ঢিবি’ নামের প্রত্নস্থানে
প্রায় ৩,৬০০ বর্গ মিটারেরও বেশি স্থানে খনন পরিচালনা করে মন্দির দুটি পাওয়া
যায়। মন্দির দুটি পাওয়ার পরে প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক দীপক রঞ্জন দাশ, বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের প্রাক্তন অধ্যাপক অরুণ নাগ ও কার্ডিফ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম হার্ডির সঙ্গে আলোচনা করে অধ্যাপক সেন
হিন্দু মন্দিরটিকে শনাক্ত করেন।
পুরো
মন্দিরটি পূর্বে, উত্তরে ও দক্ষিণে বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এই
প্রাচীর ত্রি-রথ অভিক্ষেপ বিশিষ্ট। এই ত্রি-রথ অভিক্ষেপ হিন্দু মন্দিরের
স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে তিনি জানান।
বেষ্টনী
প্রাচীর ও গর্ভগৃহের মধ্যবর্তী স্থানে পূর্ববর্তী বৌদ্ধ মন্দিরের দেয়াল ও
ভরাট করা মাটির উপরে ৩০-৪০ সেমি পুরু মেঝে রয়েছে। অধ্যাপক সেন বলেন,
“মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার পশ্চিম দিক দিয়ে ছিল। স্থানীয় মানুষজনের
‘বাড়িঘর বানানোর প্রয়োজনে’ ইট তুলে নিয়ে যাওয়ায় আয়তক্ষেত্রকার
প্রবেশদ্বারটির মূল নির্মাণশৈলী বোঝা কঠিন। সম্ভবত এখানে বড় সিঁড়ি ছিল।”
“পরবর্তীকালে
হিন্দু মন্দির নির্মাণে উপকরণের পুনর্ব্যবহারের কারণে বৌদ্ধ মন্দিরটি
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্দিরটি একটি গর্ভগৃহ ও একটি মণ্ডপের সমন্বয়ে গঠিত।
পূর্ববর্তী মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরেই পরবর্তী মন্দিরের গর্ভগৃহ নির্মিত হয়।
এর প্রবেশপথও পশ্চিম দিকে ছিল।” প্রাচীন মন্দির সাধারণত দুটি প্রধান অংশের
সমন্বয়ে নির্মিত হতো। এর মধ্যে যে স্থানটিতে প্রতিমা রাখা হতো সেটিকে বলা
হয় গর্ভগৃহ, আর যে স্থানে দাঁড়িয়ে পূজো-অর্চনা করা হতো সেটিকে বলা হয়
মণ্ডপ।
খননস্থলে
চিহ্নিত বৌদ্ধ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তেরটি বুদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পাওয়া গেছে চারটি স্তূপ ও একটি বর্গাকার মন্দির।
পরবর্তী মন্দিরের বেষ্টনী প্রাচীর ও সামনের মেঝে উত্তর-পশ্চিমাংশের
স্তূপগুলো বালি চাপা দিয়ে তার উপরে নির্মিত হয়েছিল।
এই
স্তূপগুলোর মধ্যে চারটির মধ্য থেকে পোড়ানো মানবঅস্থির টুকরা, ছাই ও কয়লার
অবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও একটি স্তূপসংলগ্ন স্থান থেকে একটি মাটির ঘটের
মধ্যে পোড়া মানবঅস্থির টুকরা ও কয়লা পাওয়া গেছে। এই ধরনের স্তূপকেই
‘শারীরিক স্তূপ’ বলা হয়ে থাকে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা
এই উপমহাদেশে সাধারণত তিন ধরনের স্তূপের নিদর্শন পেয়েছেন। দেহাবশেষের উপরে
নির্মিত শারীরিক স্তূপ, ব্যবহার্য সামগ্রীর উপরে নির্মিত পারিভাষিক স্তূপ
এবং জীবন যাপনের উপরে নির্মিত উদেশীয় স্তূপ। এছাড়া পুণ্য অর্জনের জন্যও
স্তূপ নির্মাণের উদাহরণ রয়েছে, যেটিকে বলা হয় নিবেদন স্তূপ।
“দক্ষিণ
এশিয়ায় এতকাল নিবেদন স্তূপ হিসাবে চিহ্নিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই
আসলে শারীরিক স্তূপ ছিল যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ স্থাপনার (বড় স্তূপ,
মন্দির, বিহার) কাছেই নির্মিত হত। কেবল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় মানুষজনই নন,
বরং সাধারণ অনুসারীদের মৃতদেহ সত্কার করে সেই দেহাবশেষের উপরেও এই স্তূপ
তৈরি করা হত।” তিনি বলেন, “এ ধরনের অনেক স্থানই পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের
কাছে তীর্থস্থানে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এ-ধরনের শারীরিক স্তূপ পাওয়ার ঘটনা
এই প্রথম।”
এই
আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তত্কালীন বরেন্দ্র অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মীয় সত্কার
রীতিনীতি ও তীর্থ গড়ে ওঠার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে
তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি জানান, দুই মন্দিরের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট
প্রেক্ষিত থেকে বিভিন্ন পোড়ামাটির চিত্রফলকসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু পাওয়া
গেছে। অধ্যাপক সেনের মতে, পূর্ব ভারতে ৬ষ্ঠ থেকে ১২শ শতকে বরেন্দ্র নামে
পরিচিত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন সমপ্রদায়ের সঙ্গে
বৌদ্ধ ধর্মীয় সমপ্রদায়ের মধ্যে জটিল সংঘাত ও আপসের সম্পর্ক ছিল। ধীরে ধীরে
হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন চিন্তা বৌদ্ধ ধর্মীয়দের প্রভাবিত করে, বৌদ্ধ ধর্মের
উপরে কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করে।