নূর হোসেনের সাম্রাজ্য কার নিয়ন্ত্রণে

S M Ashraful Azom
সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিশাল সাম্রাজ্যের আসল নিয়ন্ত্রক কে তা নিয়ে রয়েছে ধোয়াঁশা। তবে নূর হোসেনের বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য তারই এক সময়ের সহযোগীরা দখল নিয়ে পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে। আলোচিত ওই খুনের ঘটনার পর নূর হোসেন ও তার বাহিনীর সকলেই আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় একাধিক গ্রুপের দখলে চলে যায় তার অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য। গত এপ্রিলে সাত খুনের মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করার পর ফিরতে শুরু করে নূর হোসেনের সহযোগীরা। ফের তারা দখলে নেয় হারানো ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার। শিমরাইল মোড়, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড, ট্যাক্সি ও মাইক্রোস্ট্যান্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং, কাঁচপুর সেতুর নিচের বালুমহাল, সিদ্ধিরগঞ্জ পুলসংলগ্ন বিদ্যুত্ কেন্দ্র, আদমজী ইপিজেড, মেঘনা ও পদ্মা ডিপোসহ সকল সেক্টর নূর হোসেনের অনুসারীদের দখলে রয়েছে।
 
এদিকে, নূর হোসেনকে বিদেশে পালিয়ে যেতে এমপি শামীম ওসমান সহায়তা করেছেন- সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তে শামীম জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
 
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের অবৈধ ব্যবসা থেকে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করতেন নূর হোসেন। তিনি ভারতে পালালে তারা অনুসারীরা এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এদিকে, ভারত থেকে নূর হোসেনকে ফেরত আনার পর তার বাহিনীর কেউ কেউ এলাকায় অবস্থান করলেও বেশিরভাগই পালিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে বলে একাধিক সহযোগী জানিয়েছেন।  
 
জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় ও বাসস্ট্যান্ড নূর হোসেনের উপদেষ্টা খ্যাত সাদেকুর রহমান ও আব্দুস সামাদ বেপারী নিয়ন্ত্রণ করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী সকল যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা আদায় করে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৮টি গ্রুপ। গত সেপ্টেম্বর মাসে এদের সঙ্গে যোগ দেয় নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল।
 
শিমরাইলের ট্রাক ট্রার্মিনালটিও নূর হোসেনের ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। এখানে দৈনিক ট্রাক প্রতি ৩শ’ টাকা হারে চাঁদা আদায় করছে তার ভাই জজ মিয়া। গত সেপ্টেম্বর মাসে এলাকায় এসে ট্রাক টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নেয় জজ মিয়া বাহিনী।
 
শিমরাইল মোড়ের সিংহভাগ আয় আসত মাদক থেকে। নূর হোসেন পালিয়ে গেলে মাদক ব্যবসা কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে। অবশ্য এর কিছু দিন পরই তার সহযোগীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করলে আস্তে আস্তে মাদকের ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে। এখন তা জজ মিয়া ও শাহজালাল বাদল পরিচালনা করছেন। 
 
সাত খুনের ঘটনার পর শিমরাইল মোড়ে উচ্ছেদ অভিযানের কারণে ট্যাক্সি ও মাইক্রোস্ট্যান্ড ছিলো না। পরবর্তীতে মনির বাহিনী ডিএনডি খাল ভরাট করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড দখল করলেও বর্তমানে এটি সাত খুন মামলার এজাহার থেকে বাদ পড়া নূর হোসেনের সহযোগী আমিনুল হক রাজু ও সালাউদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে। দৈনিক প্রতি ট্যাক্সি বা মাইক্রো থেকে ৮শ’ টাকা হারে লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে।
 
শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখলে রেখে অবৈধ বালু ব্যবসা সরকার বন্ধ করতে পারলেও বর্তমানে নদীর তীরের মাটি কেটে বিক্রি করছে একটি মহল। এখানেও জজ মিয়া ও আরিফুল হক হাসানের হাত রয়েছে।
 
এদিকে, নূর হোসেনের ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আরিফ হাসান তার অবৈধ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। নূর হোসেনের নির্দেশে নূর হোসেনের স্ত্রী রুমাসহ অন্যান্য ভাই ও তাদের স্ত্রীরা আরিফের পক্ষে ভোট চেয়ে এলাকায় প্রচারণা চালায়। 
 
শিমরাইলস্থ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করত নূর হোসেনের ভাই নূরুদ্দিন। তার আত্মগোপনের পর নজরুলের শ্বশুর শহিদ চেয়ারম্যান এটি নিয়ন্ত্রণ করত। পরবর্তীতে নূরুদ্দিন এলাকায় ফিরে এলে সড়ক ও জনপথের বিভাগীয় অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
 
সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুত্ কেন্দ্র ও আদমজী ইপিজেড এলাকা নূর হোসেন ও মতিউর রহমান মতির নিয়ন্ত্রণে ছিল। নূর হোসেন ভারত পালালে এগুলো  দখলে নেয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি মতি। তার বাহিনীর দখলে পদ্মা, মেঘনা তেলের ডিপো ও সরকারি জমি।
 
গতকাল মতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এসব সেক্টরে এখন আর টেন্ডারবাজি নেই। ২ শ’ থেকে ৩ শ’ ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন। কোন ধরনের চাঁদাবাজি নেই।  মতি বাহিনীই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার বেশিরভাগ অংশ। এলাকাবাসী বলছে, এভাবে মতিই একদিন সিদ্ধিরগঞ্জের নূর হোসেন বনে যাবে। 
 
এদিকে সাত খুন মামলার চার্জশিট থেকে এজাহারভূক্ত আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমিনুল হক রাজু, হাসমত আলী হাসু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেন বাদ পড়লে তারা এলাকায় এসে ফের পূর্বের অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন।
 
এই ইয়াছিন মিয়াকে থানা আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বাদ দেয়া হলেও গত সেপ্টেম্বরে তিনি বর্ধিত সভা করে পুনরায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল হন। এরপর থেকে ইয়াছিন মিয়া ও তার বাহিনী সিদ্ধিরগঞ্জ ও শিমরাইল মোড়ের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। গতকাল এ প্রসঙ্গে ইয়াছিন বলেন, নূর হোসেনের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এর বাইরে কোন সম্পর্ক নেই। তিনি জনগণের সেবার জন্য রাজনীতি এবং ব্যবসা করেন বলে জানান। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেন। 
 
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মুহিদ উদ্দিন বলেন, নূর হোসেনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জায়গা জমি কেউ দখল করতে পারেনি। সেদিকে পুলিশ প্রশাসন নজর রাখছেন। তার জানামতে, ওইসব এলাকায় চাঁদাবাজি ও দখলবাজি বন্ধ রয়েছে।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top