‘নন্দিনী’ নামটি শুনলেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নায়িকার কথা মনে পড়ে যায়। তবে এই ‘নন্দিনী’ একটি ফুলের নাম। ১৮ বছর ধরে ভিনদেশি এই ফুল নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশি এক বিজ্ঞানী। জানিয়েছেন, গোলাপের বিকল্প হতে পারে এই ফুল। এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও রয়েছে ব্যাপক।
ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রকি পর্বত এলাকায় ‘নন্দিনী’র উত্পত্তি। আমেরিকা আর জাপানে এর বেশ চাহিদা। ইংরেজি নাম ‘লিসিয়েনথাস’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘এস্টোমা গ্রান্ডিফ্লোরাম’। ভিনদেশি এই অতিথির চমত্কার বাংলা নামটি দিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন। তিনিই বাংলাদেশে এই ফুলকে পরিচিত করিয়েছেন।
১৮ বছর ধরে এই বিদেশি ফুল নিয়ে কাজ করছেন জামাল উদ্দিন। জাপানে সেরেছেন পিএইচডি গবেষণা। দীর্ঘ গবেষণা শেষে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। জাপান থেকে বীজ ও মাটি নিয়ে আসেন। স্বপ্ন একটাই বাংলাদেশের মাটিতে ফোটাবেন ‘লিসিয়েনথাস’।
হাত দিলেন কাজে। কিন্তু বাদ সাধল আবহাওয়া। জাপানে যত সহজে চারা তৈরি করতে পেরেছেন, এখানে তা সম্ভব হলো না। অবশেষে বদ্ধ কক্ষে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় তৈরি করলেন বীজতলা। বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলে ‘স্যান্ডউইচ প্যানেল’। এখানেই তৈরি হলো চারা।
চারা রোপণের বেশ কিছুদিন পর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফুটেছে ‘নন্দিনী’। বাংলাদেশে ফোটা প্রথম ‘লিসিয়েনথাস’ দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিদিন ছুটে আসছেন সৌন্দর্যপ্রেমীরা। আর আশায় বুক বাঁধেন, তাদের শখের বাগানে কিংবা ছাদেও কোনো এক সময় ঠাঁই পাবে ‘নন্দিনী’।
রোপণের অপেক্ষায় ১০ লাখ চারা: ড. জামাল উদ্দিন ও তার সহযোগীরা তৈরি করেছেন এই ফুলের ১০ লাখ চারা। পরিকল্পনা করা হয়েছে বাণিজ্যিক চাষের। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বাছাই করা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হবে এসব চারা। বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্পর্কে ড. জামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ‘নন্দিনী’ চাষের জন্য উপযোগী। এই ফুল চাষে কৃষকরা অধিক মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবেন বলে তার প্রত্যাশা।
জানা যায়, বাজারে প্রচলিত গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা সতেজ থাকে মাত্র তিন থেকে পাঁচদিন। তবে ‘নন্দিনী’ সতেজ থাকবে ১০ থেকে ১৫ দিন। সতেজতার স্থায়িত্বের কারণেও এ ফুল সবার মনে জায়গা করে নেবে বলে বিশ্বাস ড. জামাল উদ্দিনের। ফুলটি দেখতে অনেকটা জারবেরা আর গোলাপের মাঝামাঝি। এটি প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি। একটি গাছে প্রতি মৌসুমে ১২০টি ফুল ফোটানো সম্ভব।
জামাল উদ্দিন বলেন, সারা বিশ্বে সুরভিত ফুলের চেয়ে নান্দনিক ফুলের কদর বাড়ছে। কারণ ফুলের সৌরভে পোকামাকড়সহ রোগজীবাণু বিস্তারের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া ফুলদানিতে ফুলের স্থায়িত্ব কতদিন সেটিও পুষ্পপ্রেমীদের কাছে জরুরি। এজন্য ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বাজার অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে ‘লিসিয়েনথাস’। তবে অধিকাংশ দেশই সরাসরি চারা আমদানি করে তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে।
কারণ এই ফুলের বীজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। এখনো এই গবেষণায় সাফল্য পাননি ভারত, নেপাল, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের কৃষিবিজ্ঞানীরা। তবে ‘লিসিয়েনথাস’ ফুল চাষের এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। দেশি আবহাওয়ায় ১৪ রঙের ‘নন্দিনী’ ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, একটি ‘নন্দিনী’ ফুল ৪৫টি রঙেরও হয়ে থাকে। গোলাপসহ অধিকাংশ বাণিজ্যিক ফুল সহজলভ্য শুধু শীতকালে। তবে ‘নন্দিনী’ সাধারণত জুন থেকে জুলাই মাসে ফুটলেও সারা বছরই উত্পাদন করা যায়।
চাষপদ্ধতি: ‘নন্দিনী’র চাষপদ্ধতি সম্পর্কে জামাল উদ্দিন জানান, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বা গ্রিনহাউসে চারা উত্পাদন করতে হয়। বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য দরকার হয় জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উন্নতমানের মিহি মাটি। অঙ্কুরোদগমে সময় লাগে সাধারণত ১০ থেকে ১২ দিন। চারায় চার জোড়া পাতা গজানোর পর তা মাঠে রোপণ করা যায়। আর চারায় চার জোড়া পাতা হতে ৮০ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে।
বীজ থেকে চারা উত্পাদনে দীর্ঘ সময় ও কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হলেও পরবর্তী পরিচর্যা খুব সহজ। এজন্য প্রথমেই ভালোভাবে আড়াআড়ি চাষ দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে জৈবিক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করে নিতে হবে। চাষের সময় চুনের গুঁড়ো জমিতে ছিটিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রতি বর্গমিটারে চার থেকে পাঁচ কেজি হিসাবে পচা গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করে ভালোভাবে জমিতে মেশাতে হবে। বীজতলার প্রস্থ এক মিটার হলে পরিচর্যায় সুবিধা হয়। প্রয়োজন মতো তৈরি করে নিতে হবে সেচ ও নিষ্কাশন নালা। ‘নন্দিনী’ চাষে রোগ ও পোকামাকড় সমস্যা নেই বললেই চলে।
দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মে এ ফুলটি। চারা একটু বড় হলে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফুলের আকার বড় হয়। চারা লাগানোর ২ মাস থেকেই ফুল আসতে শুরু হয়। প্রতি ডালে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি ফুল ফোটে।
ফুলটি দেখতে রক্তিম লাল বর্ণের হলেও এর ছয়টি পাপড়ি জুড়ে কালো বর্ণের ছোপ এ ফুলে এনে দিয়েছে অন্যরকম এক নান্দনিকতার ছোঁয়া। পাপড়ি ছয়টি ঘিরে রেখেছে একটি স্ত্রী কেশর এবং পাঁচটি পুংকেশরকে। সরলপত্র বিন্যাসের এ ফুলের পাতাগুলোর সম্মুখপ্রান্ত কিছুটা তীক্ষ। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফুলদানিতে ১০ থেকে ১৫ দিন ভালো থাকে। তবে ফুলদানিতে সামান্য সুক্রোজ মিশিয়ে তা ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত রাখা যায়।
উজ্জ্বল সম্ভাবনা: দেশের বাজারে এখন দেখা মেলে ‘নন্দিনী’র। তবে এগুলো আমদানি হয়েছে চীন থেকে। আমদানিকৃত এসব ফুল বিক্রি হয় প্রতিটি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। বাংলাদেশে চাষ হলে দাম ১০ টাকার মতো হবে বলে জানান ড. জামাল উদ্দিন।
লবণ-সহনশীল ফুলটি বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে চাষ করার সুযোগ রয়েছে। ফলে সেখান থেকে নৌপথে পরিবহন করাটাও সহজ হবে। অন্যান্য ফসল উত্পাদনের বিরতিতে ফুলটি উত্পাদন করা যাবে।
জামাল উদ্দিন মনে করেন, বাংলাদেশে ‘নন্দিনী’ উত্পাদনের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানসহ আশপাশের দেশগুলোতে ফুলটির চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উদ্যোগী হতে পারেন। তবে এজন্য শিল্প গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা ‘নন্দিনী’র সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছেন। তাদের মতে, গোলাপের বিকল্প হতে পারে ফুলটি। ফুলের ব্যবসা বাংলাদেশে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেকাংশেই বিদেশি ফুল আমদানির ওপর নির্ভরশীল এই ব্যবসা। ‘নন্দিনী’র বাণিজ্যিক উত্পাদনে এই সম্ভাবনাময় ফুলের পাশাপাশি বীজ ও চারা রপ্তানি করে বিদেশের বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে।