
সম্প্রতি রূপালী ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখানো হয় ৮ টাকা ৬৭ পয়সা। হঠাত্ করে এই বিশাল ইপিএস দেখে শেয়ার কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকের শেয়ারদরও বাড়তে থাকে তরতর করে। এরপর ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রকৃত ইপিএস ১১ পয়সা। ফলে আবার শেয়ারদর ব্যাপকভাবে কমে যায়।
এ রকম নানা ধরনের তথ্য জালিয়াতির ঘটনা পুঁজিবাজারের অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে হয়। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ভালো মুনাফা দেখায়। ফলে কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরই কোম্পানির আয় কমতে থাকে। কিছুদিন পর কোম্পানিটি পড়ে যায় লোকসানে। ফলে বিনিয়োগকারীরাও পড়েন ক্ষতির মধ্যে।
২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল এ তিন বছরে মূলধন উত্তোলন করা ৩৩ কোম্পানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬টি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে মুনাফা করলেও তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মুনাফা কমেছে অব্যাহতভাবে। আর ৮টি কোম্পানির মুনাফা এক বছর বাড়ছে তো পরের বছর কমছে। অথচ বাজার থেকে মূলধন উত্তোলন করাই হয়েছে মুনাফা বাড়বে এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, কোম্পানি যখন বাজার থেকে টাকা তুলে তখন বিনিয়োগকারীরা এ কোম্পানিগুলো থেকে ভালো লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেন। কিন্তু তারা যদি মূলধন বাড়ানোর পরও মুনাফা বাড়াতে না পারে তাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। এতে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরং এতে বুঝা যায়, কোম্পানিগুলো মূলধন তোলার জন্যই মুনাফা দেখিয়েছে। মূলধন তোলা হয়ে গেলে এ কোম্পানিগুলোর প্রকৃত অবস্থা বেরিয়ে আসে। আর মুনাফা করতে না পারলে বিএসইসির পক্ষ থেকেও বলার কিছুই থাকে না। তাই কোম্পানির তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতেই জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বিএসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে যা-ই করা হোক যদি কোম্পানিগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে না পারে তবে আস্থা বাড়বে না। আর বাজারও ইতিবাচক হবে না।
বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার আরেকটি কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ব্যাংকিং, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন এবং বীমা খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতে হয়। এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত স্ট্যান্ডার্ড ইন্সুরেন্সের লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ বিষয়ে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। ফলে কোনো নোটিশ না দিয়ে হঠাত্ করেই লাইসেন্স বাতিল করায় এ কোম্পানির শেয়ারদর ব্যাপকভাবে কমে যায়। এছাড়া তিতাস গ্যাসের বিতরণ ও সঞ্চালন মার্জিন কমানো নিয়েও এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ওই সিদ্ধান্তে তিতাস গ্যাস কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। এ ঘটনায় ৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা বাজার মূলধন কমে গেছে বলে ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন জানিয়েছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে এ ধরনের সমন্বয়হীনতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমার একটি বড় কারণ বলে মনে করে এসোসিয়েশন। অতি সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে তা বাস্তবে কতটুকু হবে সে ব্যাপারে আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, বাজারে এখন বড় সমস্যা হলো ভালো কোম্পানির অভাব। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি দেশে ব্যবসা করছে কিন্তু তারা বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। আর যে কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে তাদের মৌলভিত্তি খুবই নাজুক। অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ভালো মুনাফা দেখালেও তালিকাভুক্ত হওয়ার পর আর তা থাকছে না। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে আস্থা কমে যাচ্ছে। এ কোম্পানিগুলোর জন্য বাজারের বেশিরভাগ কোম্পানির তথ্যের ওপরই বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারেন না। ফলে যারা সচেতন বিনিয়োগকারী তারা অল্প কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অন্য কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারেন না। তার মতে, ভালো কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসলে এবং কোম্পানিগুলোর তথ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারলে এমনিতেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। তখন পুঁজিবাজারও ইতিবাচক দিকে ধাবিত হবে। তিনি আরো বলেন, তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা বিএসইসির সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হবে। বিশ্বব্যাপী সে রকমটাই দেখা যায়। সমন্বয়হীনতা চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না।
পুঁজিবাজারে মহা ধসের ছয় বছর পূর্তি হবে আসছে মাসেই। এই ছয় বছরে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী দিশেহারা হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে গেছেন বাজার থেকে। অনেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রির টাকা হারিয়েছেন এই বাজারে। অনেকে সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করা শেষ সম্বল হারিয়েছেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে এনে সেই টাকাও হারিয়েছেন। বাজার ধসে সর্বস্ব হারিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত নয়জন বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করেছেন। তারা হলেন— মহিউদ্দিন শাহরিয়ার, লিয়াকত আলী, দিলদার আহমেদ, রনি জামাল, আহমেদ রনি, মিল্লাত হোসেন, হাবিবুর রহমান, শারমিন আক্তার ও নাজিবুল হাসান। এর মধ্যে মহিউদ্দিন শাহরিয়ার গত ২৬ মে আত্মহত্যা করেন। বাজার ধসের ছয় বছর পরও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুরোপুরি আস্থা ফিরে আসেনি। এখনও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক মূল্য সূচক রয়ে গেছে পাঁচ হাজারের নীচেই। গত দুই মাস ধরে বাজারে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। সূচকও বেড়েছে ধীর ধীরে। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই লেনদেন ছিল তিনশ থেকে চারশ কোটি টাকার ঘরে। সূচকও ছিল সাড়ে চার হাজার পয়েন্টের নীচে। অথচ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই বাজারে তিন হাজার কোটি টাকাও লেনদেন হয়েছে। ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিজেন (এ সূচকটি বর্তমানে নেই, তার পরিবর্তে রয়েছে সার্বিক মূল্য সূচক) উঠে এসেছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। তারপরই পতনের শুরু হয়। তারপরই শুরু হতাশা। একই পরিস্থিতি দেখা যায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। সিএসইতে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বরে সিএসইএক্স ইনডেক্স ছিল ১৬ হাজার ১২২ পয়েন্টে। গত বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯৬২ পয়েন্টে। আর ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৩১৫ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার হয়েছে ৪২ কোটি ৯০ লাখ টাকা।- ইত্তেফাক