
কাক ডাকা ভোর।
ঘুম থেকে জেগে উঠে জানালা খুলে আমি হতভম্ব। আকশটাও বেশ পরিষ্কার। বেশ পরিষ্কার বলা ঠিক হলো না। একদম পরিষ্কার। ঘন নীলাকাশ।
মাঝে মধ্যে কিছু সাদা ছেঁড়া মেঘের টুকরো পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভেসে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে, সমস্ত আকাশ রঙ্গভূমিতে মেঘ ও রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপন আপন অংশ অভিনয় করছে।
আমাদের বাড়িতে সকালের দিক হৈ চৈ একটু বেশি হয়। আজ হৈ চৈ নেই। নেই কেন, এখনো বুঝা যাচ্ছে না। কী আশ্চর্য! আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখি পাশের বাসার দু’তলার কবুতরগুলো সব উড়ছে।
শুধু একটি কবুতর দলছুট হয়ে তার নিজের মতো উড়া-উড়ি করছে। তার সাদা পাখা আলোয় রূপার মতো চকচক করছে। কবুতরটাকেও বেশ সুন্দর লাগছে। বেশ না, খুব সুন্দর লাগছে। আসলে ‘বেশ’ শব্দটা উচ্চারণ করা আমার একটা দোষ। আজকের সকালটা শুরু হলো সমস্তটা সুন্দর দিয়ে। আজকের তারিখটা কত? তারিখের হিসাব রাখিনা। দিনের হিসাব রাখতে হয়। কাল সোমবার, আমাকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে হয়।
সপ্তাহের এই একটা দিন আমাদের বাড়িতে বাজারের হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও কোনো হিসাব হয় না। এর কারণ এখনো রহস্যজনক।
সোমবার বাজারের ব্যাগ নিয়ে আমাকে ছুটতে হয়। এর পেছনে একটা কারণও অবশ্য আছে।
আগে বাবা বাজার করতেন। একবার বাবা মুখ প্যাঁচার মতো করে কাঁচাবাজার থেকে ফিরলেন। তিনি একগাদা বাজার করেছিলেন। একটা লাল রঙের দেশি মোরগ কিনেছিলেন। দাম দেওয়ার সময় হঠাৎ মোরগটা হাত থেকে ছুটে গেল। বাবা বাজার ফেলে মোরগ ধরতে গেলেন। মোরগ ধরতে পারলেন না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে দেখেন তার বাজারের ব্যাগ নেই।
মা গলা নামিয়ে আমাকে বললেন, তোর বাবার শুধু যে মোরগ আর বাজার গেছে তা না, পকেটমারও হয়েছে। রিকশায় উঠে দেখে পাঞ্জাবির পকেটে টাকা যা ছিল একটাও নাই।
কত টাকা ছিল?
দু’টো পাঁচশ টাকার নোট। আর একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। তোর বাবা মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে। মন খারাপের কথাই।
তুই একটা কাজ করতে পারবি? তোর বাবার লাল মোরগের মাংস দিয়ে খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। তুই একটা লাল মোরগ কিনে আনতে পারবি? আর শোন, আজ থেকে তুই বাজার করবি, কেমন? তোর বাবার বয়স হয়েছে না।
আমি বললাম, আচ্ছা। আমাদের বাড়ির সিনিয়র মানুষের কোনো কথাতেই আমি ‘না’ বলি না।
এতে সবার ধারণা হয়েছে যে, আমি একজন অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্র ছেলে, তবে কিঞ্চিৎ বোকা। বোকা না হলে কেউ কি আর সব কথাতেই হ্যাঁ বলে? অবশ্য এই বাড়িতে আমি আমার বুদ্ধিমত্তার তেমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারিনি।
টেনে-টুনে বি.এ. পাস করে এখনো কোনো চাকরি করছি না। চাকরি করছি না বললে কথাটা ভুল হবে। চাকরির ইন্টারভিউ ও চাকরি করার সময় পাচ্ছি না। কেন পাচ্ছি না এই বিষয়টা একটু পরে বলব।
একটা খবরের কাগজের দোকানে গিয়ে তারিখটা দেখে নিতে হবে। মনে হচ্ছে আজ একটা বিশেষ দিন। আজকে প্রকৃতির কিছু একটা হয়েছে। তার রূপের দরজা আজকের দিনটার জন্য খুলে দিয়েছে। বিছানা থেকে নামলাম। খুট করে রুমের দরজা খুলে বের হতেই দেখি আমার ছোট বোন সোমা। এই সাত সকালেই ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক দিয়েছে। মানুষ সাধারণত পরপর দু’বার হতভম্ব হয় না। কিন্তু আমাকে হতে হলো। সোমার লিপস্টিক রহস্য আমার জানার দরকার নেই। তাই কারণ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করলাম না। আজকের সকালটা সুন্দর। তাই আজকের সবকিছুই সুন্দর হবে।
আজ আমার পরিকল্পনা ধীরে সুস্থে সব কাজকর্ম করা। আমি কোনো কিছু খেয়াল করছি না। এক হাতে লুঙ্গি সামলিয়ে অন্য হাতে দাঁত ব্রাস করছি। সোমা ঈগলের মতো তীক্ষèদৃষ্টিতে আমার কাছে এসে বলল, দাদা আজ আমার দিকে একটুও তাকালে না যে?
সোমার দিকে তাকিয়ে মনে হলো খুব খুশি খুশি ভাব। তার হাসিমাখা মুখটা দেখে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। সোমা বয়সে আমার দু’বছরের ছোট। খুব রূপবতী মেয়ে। শুধু রূপবতীই নয়, বাইরের লোকজনের সঙ্গে তার ব্যবহারও খুব ভালো। এবার ভালো করে সোমার দিকে তাকালাম। চকলেট রঙের সিল্কের শাড়িতে যা মানিয়েছে! কানে পাথর বসানো দুল চুনির মতো দেখতে। লাল রঙ ঝিক ঝিক করছে। প্রকৃতি স্থীর থাকলে তার রূপ চোখে পড়ে না। অনুকূলে অথবা প্রতিকূলে থাকতে হয়। তাহলে দু’টোতেই ভালো লাগে।
সোমা ও কয়েকজন পরিচিত মেয়েকে আমি প্রকৃতির সাথে তুলনা করি। এদেরকে সাদা-সিধে মুখে ভালো দেখায় না। তাদের মুখে হাসির ঝংকার থাকতে হয় অথবা কান্নার একটা ভাব। সোমাকে এই মুহূর্তে কাঁদানো সম্ভব নয়। তবে একবার কাঁদতে শুরু করলে সারা বিকেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার চেষ্টা করবে। এই সুন্দর সকালে সোমার একটা সুন্দর রূপ দেখতে হবে।
তাই ইচ্ছে করে সোমাকে কাঁদালাম, বললাম তুই এই সাত সকালে কেমন করে সেজেছিস। যেন কেমন দেখাচ্ছে।
কেমন দেখাচ্ছে?
খুকী খুকী।
তাই!
সোমা কেঁদে ফেলল। বাহ্। চমৎকার লাগছে দেখতে। তার এই রূপটিই দেখতে চাচ্ছিলাম। দেখা হয়ে গেছে। বললাম, কাঁদছিস কেন? কেঁদে ফেলার মতো কি হলো?
সোমা জবাব না দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল।
নাস্তা করতে বসেছি মাত্র। আজ নাস্তার টেবিলেও অনেক ধরনের নাস্তা সাজানো। পাউরুটির স্লাইস, পাশে মাখনের বাটি। হাফ বয়েলড ডিম সিদ্ধ। তীর আটা দিয়ে গরম কাওয়া দিয়ে নরম রুটি, গরুর গোশত ভুনা। ডিম সিদ্ধ হালকা লবণ মিশিয়ে মুখে দিয়েছি মাত্র। ঠোঁট বেয়ে কুসুম গড়িয়ে পড়ছে। ঠিক তখনি মা বললেন, শুনেছিস সোমার একটা চাকরি হয়েছে। রোজ ফ্লাওয়ার কিন্ডার গার্টেনে। লেকচারার হিসেবে জয়েন্ট। যাক খুব ভালো হলো।
সোমার চাকরি হয়েছে শুনে আমারও খুব ভালো লাগল। ইচ্ছে করছে তাকে আজ কিছু উপহার দিই। কিন্তু হাতের অবস্থা মোটেও ভালো না। দেখা যাক, কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
আমার ভালোলাগার বিষয়টি মা’র সামনে প্রকাশ করলাম না। নিস্পৃহ গলায় বললাম, ভালোই হয়েছে।
মা বললেন, আজই প্রথম জয়েন্ট।
মা কথা বলেই যাচ্ছেন। আমার মনোযোগ এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। নাস্তার টেবিলেও নেই। পশু-পাখিরা খাবার নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সময় নষ্ট করে। আমরা মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। তাই খাবার নিয়ে এত সময় নষ্ট করার সময় নেই। আর তাছাড়া এমন সুন্দর দিনে খাবার টেবিলে থাকার কোনো মানে হয় না।
রাস্তায় বের হয়েছি। রিক্সা ডাকব কি ডাকব না ভাবছি। মাথার উপর ঝাঁঝালো রোদ। চৈত্রের দীর্ঘ বাতাস বইছে। বেশ ভালো লাগছে। বেশ ভালো না ঠিক, খুব ভালো লাগছে। কিছু দিন হলো, আজিজ সুপার মার্কেট থেকে সাদা রঙের মধ্যে কালো কাজের নকশা করা একটা পাঞ্জাবি কিনেছি। এতদিন পড়ব পড়ব করে পড়াই হয়নি। আজই প্রথম পড়লাম। কেমন লাগছে দেখতে, বুঝতে পারছি না। আয়নার সামনে নিজেকে আজ দেখা হয়নি। যদিও পরিকল্পনা ছিল ধীরে সুস্থে সব কাজকর্ম করা। কিন্তু হলো না। বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করেই বের হতে হলো।
নষ্ট করার মতো সময় আজ নেই। রিক্সা নিলাম না। রাস্তায় হাঁটতেই ভালো লাগছে। রাস্তা বেশ ফাঁকা। কোনো গাড়ি নেই-ই বললে চলে। কারণ কী?
এখনতো আর হরতাল অবরোধ বলে কোনো শব্দ নেই দেশে। কিছু দিন আগে ছিল। এক ধরনের জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি। রাস্তায় বাসে ট্রেনে পেট্রোল বোমা মারা হতো। পেট্রোল বোমা যে কত মানুষের জীবন সংসার কেড়ে নিল!
আজকের ঘটনাটা কী? সামনে পত্রিকার একটা দোকান আছে। সেখানে গেলেই সব জানতে পারব। পত্রিকার দোকান আর চা স্টলের সামনে অনেক বয়স্ক বেকাররা টকশো করে। তাদের কাছে বিবিসির চ্যানেলও ফেল। আমার কাজ হবে শুধু পত্রিকার দোকানে গিয়ে একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার ভান করা। বাকি সব তাদের মুখ থেকে শুনব। পত্রিকা পড়া ধৈর্যের কাজ সাথে আমার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সময় নষ্ট।
অবশ্যই আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও অন্যরা মানতে চায় না। আমি কেন গুরুত্বপূর্ণ তার একটা উদাহরণ দিই।
গ্রাম থেকে কোনো আত্মীয়-স্বজনের অসুখ হয়ে ঢাকায় এলে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সবকিছুই আমাকে করতে হয়।
এইতো সেদিন মেঝো খালু অসুস্থ হয়ে এলেন। হাসপাতালে ভর্তি করালাম। হঠাৎ ডাক্তার বললেন, প্যাসেন্ট ভেরি সিক। রক্ত লাগবে। বি-পজিটিভি। একজন ব্লাড ডোনার ম্যানেজ করেন। কুইক। প্যাসেন্ট ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ রৌদ্রের মধ্যে ছুটাছুটি করে হাসপাতালে ভর্তি করা। কেবিন ম্যানেজ। একবার এ ডাক্তার ঐ ডাক্তার। তারপর ব্লাড ডোনার খুঁজাখুঁজি।
অবশেষে কোনো ব্লাড ডোনার খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ বেলাতে আমি বললাম, আমার বি-পজিটিভ। আমিই রক্ত দিবো। খালুজান যখন সুস্থ হলেন, আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, তুমি যথেষ্ট কষ্ট করেছ।
না, কি বলেন খালুজান। এটা আর তেমন কী?
শুনলাম তুমিই রক্ত দিছ?
জী, খালু।
জোয়ান পোলা, এক ব্যাগ রক্ত দিলে তেমন কিছুই হয় না।
আমি মাথা নিচু করে জী বললাম।
কিছুক্ষণ পর খালু বললেন, রক্তে কোনো বিষ নাইতো?
আমি খালুর দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে বললাম, বুঝলাম না কথাটা।
না বুঝার কী আছে? বেকার পোলা কওনতো যায় না। গাজা-ভাং এর কথা। আচ্ছা যাওকগা। এই লও একশো টেহা। আঙ্গুর কিনে খাইও। রক্ত যা দিছিলা আবার পুরুন হইয়া যাইব।
আমি অবশ্য কিছু মনে করি না। কারণ দিন দিন আমার চামড়া গণ্ডারের মতো মোটা হয়ে যাচ্ছে।
শুধু প্যাসেন্ট এটেন্ডেন্স হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, দেশের বাইরে থেকে কোনো আত্মীয় এলেও আমাকে রিসিভ করতে হয়। এইতো মাসখানিক আগে গ্রাম সম্পর্কে চাচা হন, তিনি এলেন সৌদি থেকে। তাদের পরিবারের লোক প্রায় নয়-দশজন বিমান বন্দরে উপস্থিত। তারপরও আমাকে যেতে হলো। আমাকে দেখে চাচা খুব খুশি গলায় বললেন, আমার পরিবারের লোকজন কোথায়? এয়ারপোর্টে আসেনি?
বললাম, বাইরে অপেক্ষা করছে।
গাড়ি আসেনি আমাকে নিতে?
জী, একটা মাইক্রোবাস ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
বাহ্, সুন্দরতো। তুমিও আমাদের সাথে মাইক্রোবাসে যাবা।
আমি ইতস্তত করে বললাম, ঠিক আছে।
মাইক্রোবাসে হুড়োহুড়ি করে সবাই উঠে বসলো।
সূচ ফেলার জায়গা নেই। যে যার মতো সিট নিয়ে বসেছে। তবুও চাচা আমাকে ছাড়লেন না। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, ভাতিজা কষ্ট করে ওঠো, জায়গা হবেই। আমি মাইক্রোবাসে উঠে কোনোরকম হামাগুড়ির মতো বসলাম। চাচা একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছেন। সব সৌদির গল্প। প্রচণ্ড গরম সবাই ঘেমে গেছে। লক্কর-ঝক্কর মাইক্রোবাস। সবার শরীর থেকে বিকট ঘামের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
চাচা বললেন, ভাতিজা এখন কী করছ?
কিছু না।
চাচা যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
বললেন, এরপর আবার যখন আসব তখন তোমার জন্য একটা ভিসা আনব। আমার সাথে সৌদি যাবে। এখন থেকেই সৌদি সম্পর্কে কিছু শিখে রাখ। পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কেও সচেতন হয়ে নাও।
এ ধরনের আশার বাণী আমাকে শুনতে হয়। কারণ চোখের পাপড়ি আছে কিছু দেখতে না ইচ্ছে করলে বন্ধ করা যায়। কানের কোনো পাপড়ি নেই। তাদের আশার বাণীতে আমি উপেক্ষাও করি না আবার প্রতিক্ষায়ও না। আমাকে সবাই মিথ্যে আশ্বাস-অবহেলা দিবে জানি। একদম সত্য। সত্য।
এমন সুন্দর দিনে এমন করে ভাবতে নেই। ভাবনা থেকে ফিরে এলাম। এতক্ষণে দেখি অনেক পথ হেঁটেছি। কখন যে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটা শুরু করেছি খেয়াল করিনি। রাস্তার পূর্বের দৃশ্য থাকলে নির্ঘাত মৃত্যু।
একদল তরুণীকে দেখলাম আমার পাশ কাটিয়ে গেল। কী মিষ্টি গন্ধ! তাদের পরনে কামিজ এবং প্লাজো। কী এমন যুগ এলো যে পায়জামার নাম হলো প্লাজো, না পায়জামা না পেটিকোট। অথচ শাড়ি পড়লে তাদের কী সুন্দরই না লাগত!
আমার øায়ু অবশ হয়ে আসছে সেই সকাল থেকে। এখন তা আরো বাড়ছে। ইচ্ছে করছে ঢাকার সবগুলো বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়ে লিখে দেই
হে রাজপথের মুকুট বিহীন রাজা,
একটু চেয়ে দেখ আকাশের দিকে।
কী সুন্দর তার রূপ!
চৈত্রের দীর্ঘবাতাস যেন আছড়ে পড়ছে
সব তরুণীর শাড়ির আঁচলে।
এখনো বুঝনি। আজ অপূর্ব একটি দিন।
ভ্যাবদার চিন্তা-ভাবনা থেকে সরাসরি ধুলা-কাদার পৃথিবীতে চলে এলাম। খানিকটা দূরে দৃষ্টি দিতেই দেখি সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পড়া বয়স্ক ধরনের লোক গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। তাকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড়। জনতা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। ধীর পায়ে ভিড়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। ঘটনার সূত্রপাত কিছুটা জানতে পারলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ রাস্তার পাশে তাজা-জেতা শিং মাছ দেখে তা কিনে ফেলেন। অতি আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলে তার হাতে শিং মাছ গোতা দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলে রক্ত বের করে দেয়। সবুজ পাঞ্জাবিতে লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। শিং মাছ ও তার রক্তাক্ত আঙ্গুল জনতার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ মিশ্রিত আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
বয়স্ক ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী? আপনারা শিং মাছ এর আগে দেখেন নাই? যান যান কাজে যান। অকাজে সময় নষ্ট করছেন কেন? আপনাদের কোনো কাজ নেই?
কাজে যাওয়ার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। কারো হয়তো কোনো কাজ নেই। আমারও আজ কোনো কাজ নেই। আজ যা দেখছি সবই ভালো লাগছে। ভালো লাগবেই না কেন? আজ অপূর্ব একটা দিন।
কয়েকটা শিং মাছ ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্তার পাশে আইল্যান্ডে নড়াচড়া করছে। ভদ্রলোক মাছগুলোকে ধরে ব্যাগে তোলার চেষ্টা করছেন। আমিও এগিয়ে গেলাম তাকে সাহায্য করতে।
বয়স্ক ভদ্রলোক হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, কেমন আছ?
অপরিচিত কেউ কেমন আছ বললে আমরা জবাব দেই না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকি কিংবা বলি, আপনাকে চিনতে পারছি না।
আমি তা করলাম না, সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে বললাম, জী ভালো।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপরে হবে।
মাথাভর্তি চুল। চুলে পাক ধরেছেমাথার আধাআধি চুল পাকা। এই পাকা চুলই তার চেহারায় একটা আভিজাত্য আভিজাত্য ভাব এনে দিয়েছে।
কী ব্যাপার বলতো ইয়াং ম্যান, তুমি আমাকে সাহায্য করছো?
আমি কোনোকালেই লজ্জা পাইনা। আজ কেন যেন লজ্জা পেলাম। লজ্জা স্বরে বললাম, মাছগুলো মুক্ত হয়ে আনন্দে লাফাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছিল। তাছাড়া আপনি একা একা মাছগুলোকে ধরে তুলতে পারছেন না।
ভদ্রলোক শুধু হাসলেন। শিং মাছের গোতা খেয়ে এই বয়স্ক ভদ্রলোক কীভাবে হাসতে পারছেন। বিষয়টি আমার মাথায় ঢুকছে না। মাছ ব্যাগে তোলা শেষ হলে ভদ্রলোক তার সাথে আমাকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন।
প্রথমে আমি মনে মনে নিজেকে না করলাম। বাস্তবে প্রকাশ করতে পারলাম না। মনে হয় এই অপূর্ব দিনের কারণেই। পথেই পরিচয় হলো। ভদ্রলোকের নাম মোখলেছুর রহমান। পেশা আর্কিটেক্ট ও ফাস্টক্লাস কন্টাক্টরের কাজ করেছেন দশ বছর। টানা দশ বছর কন্টাক্টরের কাজ করার পর হঠাৎ ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমান পেশা ও নেশা দেশের বাইরে ভ্রমণ ও বই পড়া।
মোখলেছুর রহমানের বাড়ির সামনে গিয়ে আমি হতভম্ব। আজ কেন এত হতভম্ব হচ্ছি বুঝতে পারছি না। আজ অপূর্ব দিন এই কথাটা মনে হচ্ছে ভুল। আজ হতভম্ব দিন!
বিশাল জায়গায় নীল রঙের তিনতলা একটা বাড়ি। সামনে বড় একটা বাগান। মাঝখানে একটা ডলফিন মাছের ভাস্কর্য, তার মুখ থেকে অপূর্বভাবে পানি ঝরছে। বাড়ির নাম শান্তি নীড়।
বাড়ির মেইন গেটে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে লেখা যে, শান্তি নীড়, উত্তরা ১০নং সেক্টর, শান্তি নামের বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় এই সকল বাড়িতে অশান্তি আছে। এই অশান্তি দূর করার একটা বাহ্যিক চেষ্টা শান্তি কুঠীর অথবা শান্তি ছায়া, শান্তি নীড় দিয়ে বাড়ির নাম রাখা। এই বাড়িতে ঝামেলা আছে কিনা তা পরে দেখা যাবে।
এতক্ষণ যা ভাবছিলাম হয়তোবা চুলের কারণে মোখলেছুর রহমানকে আভিজাত্য আভিজাত্য মনে হচ্ছিল। আসলে তা নয়। তিনি আসলেই অভিজাত শ্রেণির এবং সুপুরুষ। বাড়ির সামনের বাগানের একটি বহু পুরনো বৃক্ষের নিচে কাঠের বেঞ্চের উপর দু’জনই বসলাম। বাড়িটা খুব হলে দশ-পনেরো বছর আগে করা হবে। কিন্তু এই রকম পুরনো বৃক্ষ রহস্যময়।
সব বাড়িতেই কিছু রহস্য থাকে। এই বাড়িতেও এই গাছ রহস্য থাকুক। মোখলেছুর রহমানকে দেখে সবসময় বাড়ির কাজে খাটে এরকম একজন দৌড়ে এসে মাছের ব্যাগ নিলো।
মোখলেছুর রহমান তাকে মগে করে তার হাত পরিষ্কার করে দিতে বললেন।
মোখলেছুর রহমান তাকে বললেন, শিং মাছে কাঁটা দিয়েছে বুঝলি। তারপর রক্তাক্ত। শিং মাছের মাথায় বিষ এলো কীভাবে জানিস?
জে না।
কোনো দিন নানী দাদীর কাছে শোনস নাই।
জে না।
আমার সারা কাপড়ে রক্ত। ছোপ ছোপ রক্ত দেখে ভয় পাইছস?
জে।
এখন শোন শিং মাছের মাথায় কীভাবে বিষ এলো। না থাকুক, গল্প পরে এক সময় শোনাব। সাথে ভেরী ইয়াং গেস্ট আসছে তুই বাবুর্চিকে রান্নাবান্নায় সাহায্য কর, যাহ্। আর আজ দুটো আইটেম বাড়িয়ে করতে বলিস।
বুঝলে ইয়াং ম্যান, ওর নাম বারেক।
দশ বছর বয়স থেকে আমার বাড়িতে। খুব সরল সোজা। ডানে যেতে বললে ডানে, বামে যেতে বললে বামে যায়।
তোমার কি স্মোকিং অভ্যাস আছে?
মাথা নিচু করে বললামর জী আছে। তবে গোপনে করি। রাতের বেলায়। আমার রুমের বারান্দা হলো স্মোকিং কর্ণার।
মোখলেছুর রহমান পাঞ্জাবির পকেট থেকে ব্লু কালারের এক প্যাকেট মার্লবোরো সিগারেট বের করে প্যাকেটের মুখ ওপেন করে আমার সামনে ধরলেন, নাও, ধরাও।
সিগারেটটা দেখতে খুব সুন্দর, চিকন ধরনের সিগারেট। আমি খুব সংকোচবোধ করলাম।
সিগারেট হাতে নিয়ে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমি সিগারেট বাড়ির বাইরে খেতে চাই।
কেন?
এত সুন্দর বাড়িতে সিগারেট মানায় না।
আসল বিষয় এটা না, তুমি লজ্জা পাচ্ছ। ইয়াং ম্যান। তাই না?
আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, জী।
যে কাজ গোপনে করা যায় সেই কাজ প্রকাশ্যেও করা যায়। তুমি এখানেই খেতে পারো। কোনো বাধানিষেধ নেই।
সিগারেট ঠোঁটে ধরাব মাত্র ঠিক তখনই লক্ষ করলাম বাড়ির ভেতর থেকে এক রূপবতী মেয়ে আমাদের দিকে আসছে। মেয়েটি ডান পা টেনে টেনে হাঁটছে। হাঁটা দেখে মনে হয় পায়ে কাঁটা ফুটেছে। হঠাৎ আমাদের সামনে এসে মোখলেছুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে মায়াকান্না শুরু করল। কান্নার সাথে কী যেন বলছে শুধু একটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ‘বাবা রক্ত’।
মোখলেছুর রহমানও বেশ অবাক হলেন।
এই কান্নার মাঝখানেই মেয়েটির পরিচয় পেয়ে গেছি। সে মোখলেছুর রহমানের একমাত্র মেয়ে। কী সুন্দর সাদা-সিধে দেখতে! পরিষ্কার জলেই কেবল পদ্ম হয়, পচা জলে কখনো পদ্ম হয় না।
সে তার বাবাকে হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তোবা তার বাবার রক্তমাখা পাঞ্জাবি দেখে আমাকে খেয়াল করেনি। মোখলেছুর রহমান ও তার মেয়ে বাড়ির ভেতরে গেলে।
আমি সোমাকে নিয়ে চিন্তা করছি। আজ তার প্রথম চাকরি হয়েছে। তাকে কী উপহার দেওয়া যায়? কিছুক্ষণ পরই বাড়ির বারান্দা থেকে মোখলেছুর রহমান আমাকে ভেতরে আসার জন্য হাত ইশারা করছেন। মোখলেছুর রহমানের সাথে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। এয়ারকুলার লাগানো ঘর। ডিসটেম্বার করা আকাশী দেয়ালের ঠাণ্ডা ঘর। পর্দার রঙ আকাশী। দেয়ালে দুটি ছবি আছে। দুটির বিষয়বস্তুও আকাশী। একটায় নীল আকাশ, একটায় নীল সমুদ্র। এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছেতারা সমুদ্র এবং আকাশের মতো বিশাল।
দুপুরে খাওয়ার পর মোখলেছুর রহমান তার একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে বারান্দা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিলেন।
তার কিছুক্ষণ পর আমি আবার সেই পুরনো বৃক্ষের নিচে বেঞ্চে বসে আছি। ঠোঁটে বিদেশি মালবোরো ব্রান্ডের সিগারেট। মোখলেছুর রহমান বলেছেন তুমি এইখানে বসে স্মোকিং করতে পারো, কোনো বাঁধানিষেধ নেই।
চৈত্রের ঘন নীলাকাশ, পেঁজাতুলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। পুরনো বৃক্ষের ছায়া।
কী বিশাল শান্তি নীড়! এই অপূর্ব দিনে আমার মনে নেই আজ কোনো গোপন ইচ্ছে। গভীর আনন্দে কেন জানি আজ আমার হৃদয় পূর্ণ।
⇘সংবাদদাতা: সেবা ডেস্ক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।