
স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৯৭১ সালে যশোর ক্যান্টমেন্টে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। সিপাহী নং-৬৫৭৪২৩০ আব্দুল করিম মিয়া স্বাধীন বাংলার কট্টর সমর্থক ছিলেন। দক্ষ ড্রাইভার হিসেবে পাকসেনাদের টার্গেট হন সিপাহী আব্দুল করিম মিয়া। তিনি ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে (৪৯ এমটি প্লাটুন) সিপাহী পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি যশোর সেনানিবাসের এএসসি কোরে এমটি ইয়ার্ডে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৯মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোর সেনানিবাসের তিনিই প্রথম শহীদ হন।
জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলা’র বাঘাডোবা গ্রামের মৃত নিদান মিয়ার ছোট ছেলে ছিলেন শহীদ আব্দুল করিম মিয়া। ৩মাস পর শহীদ হবার খবর জানেন করিমের পরিবার। সাম্প্রতিককলে শহীদ করিম মিয়ার একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে আব্দুর রহিম মিয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে জামালপুর জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন। অবেদনের প্রেক্ষিতে জামালপুর জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান যশোর সেনানিবাসে প্রত্রযোগাযোগ করেন। যশোর এরিয়া সদর সেনানিবাসের রেকর্ডস ওআইসি’র পক্ষে লে:কর্ণেল মো: শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং সেনানিবাসের পক্ষে এরিয়া কমান্ডার লে:কর্ণেল গাজী শহীদুল্লাহ লিখেন- ২৯মার্চ যশোর সেনানিবাসেই সিপাহী আব্দুল করিম মিয়া পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।
পাকসেনারা যশোর আর্মি কোয়ার্টেরে প্রবেশ করেছে। খোঁজ নেয়া হচ্ছে-বাঙ্গালীর সেনার পরিবার আছে কী না। বাঙ্গালী কোয়ার্টারের বারান্দায় দাড়িয়ে আছেন-করিম মিয়ার স্ত্রী বিদুয়ারা বেগম শেফালী। তিনিও করিম মিয়ার ন্যায় বিশাল দেহ তারূ। কোলে ২মাস ২৫দিনের একমাত্র শিশু রহিম মিয়া। নাম । ফিসফিস করে দ্ইু পাকসেনা উর্দ্দু-ইংরেজী ভাষায় একে অপরকে বলছে-এ কোন আওরাত হায়? অন্যজন বলেন-করিম মিয়াস ওয়াইফ। অপরজন বলাবলি করছিল-করিম মিয়া! ও- ৩০ মার্চ ফুউত হোয়া। অন্যজন বলে ঠেরো ঠেরো। ওই কক্ষটি চিল করিম মিয়ার জন্য বরাদ্দ। সেখানে থাকতেন বৃদ্ধা মা-সাইদুন্নেছা, স্ত্রী বিদুয়ারা বেগম শেফালী। ২মাস ২৫দিনের একমাত্র শিশু আব্দুর রহিম মিয়াকে কোলে নিয়ে ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে ওদের কথা শোনছিলেন শেফালী। করিম মিয়ার স্ত্রী শেফালীর বংশগতভাবেই উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের। দীর্ঘদিন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানের কারণে সেনাদের ভাবভাষা বোঝার দক্ষতা ছিল। স্বামীর মুত্যুর খবর আঁচ করতে পেরে শেফালীর অজান্তেই চোখের পানি ঝরছে। স্মৃতির জগতে শেফালী দেখছে- ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। করিম মিয়ার পরিবার জানতেন-তিনি ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধ করছেন। ৩মাস অতিবাহিত হলেও, পরিবারের কেও জানতেন না করিমের খবর। জিজ্ঞাসা করলে বলা হতো; উনি ওয়েস্ট পাকিস্তানের করাচীতে গাড়ি নিয়ে গেছেন। আবার আসবেন বলে শান্তনা দেয়া হতো।
স্ত্রী শেফালীর শাশুড়ী সাইদুন্নেছার গলাজড়িয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। পরে করিম সাহেবের এক ঘনিষ্ট সহকর্মী ড্রাইভার লাল মিয়া যাকে এরশাদ সরকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মিরপুর-১ নাম্বারে সরকারি বাসা বরাদ্দ দেন। তার নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন-৭হর্স এমটি চেকপোস্টের ভিতরে করিম মিয়ার কবর। এর চেয়ে বেশী বলার ক্ষমতা এবং সুযোগ আমার নেই। এই টুকু জানাজানি হলে আমার প্রাণ যেতে পারে। বলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে দ্রুত সটকে পড়লেন। পাগল প্রায় স্ত্রী শেফালী দৌড়ে গেলেন মেজর ফারুকের কাছে।
মেজর ফারুক তখন প্যারেড গ্রাউন্ডে ছিলেন। শেফালী মেজরের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কেঁদে কেঁদে বল্লেন-আমার সহোদর বড় ভাইয়ের নাম ফারুক খান। সেই সুবাদে আপনাকে বড় ভাইয়ের দোহায়! আপনি আমার স্বামী করিম মিয়ার সর্বশেষ খবর আপনার মুখ থেকে জানতে চাই। স্ত্রীর কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এ দৃশ্য দেখে মেজর ফারুকও দু’চোখের জল মুজছেন। মেজর চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন-৩০ মার্চে পাকসেনারা তাকে হত্যা করেছে। ওই সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের জন্ম দেয়। উপস্থিত সেনারাও কাঁদছেন। শান্তনার বানী শুনিয়ে শেফালীকে বিদায় দেয়ার চেষ্টা করেন। শেফালী তখন বল্লেন-কিভাবে কোথায় হত্যা করেছে? জানতে চাই।
স্ত্রী শেফালী বলেন-আমার কোলের শিশু বড় হলে; পিতাকে দেখাতে পারব না। বড় হলে কাকে আব্বু ডাকবে? যেন আমার শিশুকে অন্তত: পিতার কবর খানা দেখাতে পারি। এজন্য আপনি আমার স্বামীর কবরটি নাম ফলসহ পাকা করবেন। কথা দেন। কথা দেন মেজর সাহেব কথা দেন...। স্বামীর নাম ফলক কবর নাদেখে আমি ফিরে যাব না। টাকা নাথাকলে আমাদের টাকাই করে দিবেন। অবশেষে মেজর আশ্বাস দিয়ে বলেন, ডিপার্টমেন্টের টাকায় করিম মিয়ার কবর পাকা করে দিব।
পরবর্তীতে জানা গেছে, ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসে সেনা পিকআপ-ভ্যান যোগে দুপুরের খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন করিম মিয়া। ক্যান্টমেন্টে পৌঁছামাত্রই পাকসেনারা আব্দুল করিম মিয়াকে ঘিরে ফেলে। তিনি ৬ফুট দীর্ঘ ও বিশাল দেহের অধিকারী সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। আব্দুল করিম মিয়া পাকসেনাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য একাই দুই পাকসেনাকে কাবু করে ফেলেন। এতে অন্যান্য পাকসেনারা আব্দুল করিমকে গুলি করে জাঝরা করে দেন। তাঁর রক্তে পাকা রাস্তা ভিজে যায়। কিন্তু তখনো আব্দুল করিমের প্রাণ নি:শেষ হয় নি। হত্যাকান্ডের স্থানের পিছনেই ফেমিলি কোয়ার্টার ছিল। এ সময় পাকবাহিনীরা বন্দুকের ব্যানেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে আব্দুল করিমের মাথা থেতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
শহীদ পরিবারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্ণ ঠিকানা সম্বলিত যশোর ক্যান্টমেন্টের একমাত্র পাকা কবরটিই হচ্ছে-শহীদ সিপাহী আব্দুল করিম মিয়ার কবর। বাকিদের কলাবাগানের গণকবর হয়। যা আজো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরুমন্থন করে। ১২ ল্যান্সার আরপি চেকপোস্টের ভিতরে হাতের ডান পাশের একমাত্র শহীদ আব্দুল করিম মিয়ার পাকা কবরটি অবস্থিত। পাকা কবররের দেয়ালে লেখা-শহীদ সিপাহী আব্দুল করিম, ৪৯ এমটি প্লাটুন এএসসি, শহীদ ৩০ মার্চ/১৯৭১ ইং, যশোর সেনানিবাস লেখা আছে।
২০০৯ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন-উ-আহমেদ এনডিসিপিএসসি কর্তৃক নির্দেশকৃত বিশেষ বাংলাদেশ আর্মি অর্ডার ভিত্তি এসবিএও নং-০৩/১০৬/২০০৯। মুক্তিযোদ্ধা প্রভিশনাল সার্টিফিকেট-গেজেট খন্ড নং-১২, ক্রমিক নং-৫৩২১/২০১০। স্থান-ঢাকা সেনানিবাস। নথি নম্বর-৩১৩২/২২/এজি/পিএ-১ (সি), তারিখ-০৯ ডিসেম্বর’ ২০১০। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদপত্র নং-ম...১৮৮২৯১। শহীদ আব্দুল করিম মিয়া। জামালপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বোর্ডে বীর শহীদের ৬৭নং তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে আ: করিম। পিতা মৃত- নিদান মিয়া, গ্রাম-বাঘাডোবা, থানা-মেলান্দহ, জেলা-জামালপুর।
করিম মিয়ার শহীদ পরিবারের একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে শহীদ ভাতা কিংবা প্রতিবন্ধী ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান দুটি কোঠা থাকতেও সরকারি চাকরী থেকে বঞ্চিত। বহু ইন্টারভিউ দিয়েছেন। কিন্তু চাকরী হয়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে নি:স্ব-ভূমিহীন হিসেবে ১৫ডিসেম্বর ২০১৪ ইং তারিখে দরখাস্ত করেও কোন ফলাফল হয়নি। ১৩/১০/১৬ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শহীদ ভাতার আবেদন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসে ঘোষণা প্রদান করেন-সাধারণ শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেমন শহীদ ভাতা রেশন পান, তেমনি সশস্ত্রবাহিনীর শহীদরাও সরকারি শহীদভাতাদি রেশনসহ সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। কিন্তু ২০১৬ সাল অতিবাহিত হলেও তা বাস্তবায়ন হয় নি। সেনানিবাসের প্রথম শহীদ হিসাবে আব্দুল করিমের স্মরণে পাকা কবর ছাড়া আর কিছুই নেই।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককলে শহীদ করিম মিয়ার একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে আব্দুর রহিম মিয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি-শহীদমুক্তিযোদ্ধা কোঠায় চাকরী এবং ভাতার জন্য জামালপুর জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও কোন প্রতিকার পান নি। জামালপুর জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান যশোর সেনানিবাসে পত্রযোগাযোগ করেন। যশোর এরিয়া সদর সেনানিবাসের রেকর্ডস ওআইসি’র পক্ষে লে:কর্ণেল মো: শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং সেনানিবাসের পক্ষে এরিয়া কমান্ডার লে:কর্ণেল গাজী শহীদুল্লাহ-২৯মার্চ যশোর সেনানিবাসেই সিপাহী আব্দুল করিম মিয়া পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন-উ-আহমেদ এনডিসিপিএসসি কর্তৃক নির্দেশকৃত বাংলাদেশ আর্মি অর্ডারে শহীদ সিপাহী আব্দুল করিমের নাম প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পান নি শহীদমুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির-সন্তান কোঠায় চাকরী কিংবা ভাতা। এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তান আব্দুর রহিম মিয়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে নি:স্ব-ভূমিহীন হিসেবে দরখাস্ত করেও সাড়া না পাওয়ার আকুতি জানান। চরম দৈন্যদশায় দিন চলছে তার।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী টিভিতে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনাহত্যাকান্ডের খবর দেখে; ৭১’র আব্দুল কমির মিয়াকে হত্যার স্মৃতি মনে পড়ে। আর তখনই স্ত্রী বিদুয়ারা বেগম শেফালীর চিৎকার দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। শহীদ পরিবারের একমাত্র ছেলে প্রতিবন্ধী রহিম মিয়ার দুর্বিষহ অবস্থা প্রত্যক্ষ, পিতা-মাতার মৃত্যৃর বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদন তৈরীকালে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। যা স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তর থেকে পিলখানা।
টীকা: পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনাহত্যা বন্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ আসনের এমপি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মির্জা আজম (বর্তমানে পাট-বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী) এবং যুবলীগের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক সাদাপতাকা হাতে পিলখানায় প্রবেশ করেন। সেখানে বিডিআরদের হত্যা বন্ধের আহবান জানালে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে বিপদগামী বিডিআরদের বিচার করা হলেও; নিহত সেনাদের ফিরে পাবার সুযোগ নেই। যা ইতিহাসে বেদনাদায়ক অধ্যায়।

লেখক
মানবাধিকার কর্মী ও সভাপতি
মেলান্দহ রিপোর্টার্স ইউনিটি,
জামালপুর।
⇘সংবাদদাতা: শাহ জামাল
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।