বকশীগঞ্জে উচ্চ ও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত চরের শিক্ষার্থীরা

S M Ashraful Azom
0
বকশীগঞ্জে উচ্চ ও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত চরের শিক্ষার্থীরা
জিএম ফাতিউল হাফিজ বাবু: জামালপুরের বকশীগঞ্জে উচ্চ শিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত চরের ছাত্র-ছাত্রীরা। যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব ও অভিভাবকদের অসেতনতার কারণে পিছিয়ে পড়ছে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। বকশীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষার হার ৪০ শতাংশ হলেও চর ঘেষা ইউনিয়ন গুলোতে আরো নিচে রয়েছে শিক্ষার হার। এ কারণে চরের কাঙক্ষিত উন্নয়ন ও মানসিকতার বিকাশ ঘটছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চরের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিস্থিতি। বকশীগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে মাদারের চর গ্রাম। গ্রামটি মেরুরচর ইউনিয়নে অবস্থিত । এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনে নিষ্পেষিত মাদারের চর সহ এই ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের মানুষ। পিছিয়ে রয়েছে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কতুবের চর, মদনের , চর কামালের বার্তী, শেক পাড়া, বাংগাল পাড়া চরের শিক্ষার্থীরাও।

শিক্ষা-দীক্ষায়, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, চাকুরী, উন্নয়ন, কৃষি সব সব দিক পিছিয়ে মেরুরচর ইউনিয়নের মাদারের চর, মাইছানির চর, ঘুঘরা কান্দি, উজান কলকিহারা, ভাটি কলকিহারা, বাগাডুবা, ফারাজিপাড়া,পূর্ব কলকিহারা গ্রাম ও সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। এই গ্রাম গুলোর প্রকৃতি একেক রকম। ব্রহ্মপুত্র নদ ও দশানী নদী মেরুরচর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামকে বিভক্ত করে রেখেছে।

মেরুরচর ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামই চর। তারমধ্যে মাদারের চর, মাইছানির চর, উজান কলকিহারা, ভাটি কলকিহারা, ঘুঘরা কান্দি, পূর্ব কলকিহারা, বাগাডুবা, সেকেরচর গ্রাম শতভাগ চর। ভোরের আলো বের হওয়ার সাথে চরের ধুলিকনার সঙ্গে উঠাবসা এই এলাকার মানুষের। এদের জীবন জীবিকাও নির্ধারণ হয় এই চর থেকে। মাটির উর্বরতা শক্তি না থাকায় এসব চরে তেমন ফসলও হতো না এক সময়। শুধুমাত্র বাদাম আর আখ ছাড়া অন্য কোন ফসল উৎপাদন হতো না এই চরে।

চরাঞ্চলের মানুষ তাদের জীবন সংগ্রামে নানা ভাবে বেঁচে থাকলেও শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে কোমলমতিরা।

ছেলেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছালেও মেয়েদের বেলায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এই এলাকার ১৩-১৫ বছরের একজন মেয়ে তার বাবার পরিবারে অভিশাপ। উচ্চ শিক্ষা তো দূরের কথা অনেক সময় মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতেই পড়ার সুযোগ হয় না তাদের। তার আগেই ঝড়ে পড়তে হয় সেই মেয়েটিকে। অর্থাৎ বাল্যবিবাহের প্রবণতা খুবই বেশি এই এলাকায়।

অপরদিকে পেটের তাগিদে ছেলেটিকেও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরা বা রোজগারের পথ বের করতে হয়। এরই নাম চরের জীবন। শত প্রতিকূল পরিবেশে একজন মানুষকে জীবনযাপন করতে হয় ।

মেরুরচর ইউনিয়নের মাদারেরচর গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। রয়েছে একটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের নাম মাদারের চর নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০০২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি ও মাধ্যমিক শাখা খোলা যায় নি। বিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখতে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কয়েকটি ভাঙা বেঞ্চ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি এই বিদ্যালয়ে। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পাঠদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে শিক্ষকরা। ফলে এখন শুধু বিদ্যালয়ের টিনসেড ঘরটি পড়ে থাকলেও শিক্ষার্থীদের দেখা মিলছে না। শিক্ষকরাও বেতন-ভাতা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন।

মাদারের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে দূরের কোন শিক্ষক আসতে চায় না।
প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের কঠোর নজরদারি  ও সামাজিক জবাবদিহিতা না থাকায় শিক্ষকরা সময় মত বিদ্যালয়ে আসতে চান না বলে অভিযোগ রয়েছে। কোন দায়বদ্ধতা নেই শিক্ষকদের। এই গ্রামের কোন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা দাখিল মাদরাসায় পড়তে হলে তাকে কমপক্ষে ৬ কিলোমিটার দূরে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। কলেজে পড়তে হলে ১৪ কিলোমিটার দুরে গিয়ে পড়তে হয়।

যে কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দক্ষ শিক্ষক না থাকায় এসএসসি কিংবা দাখিলে তেমন ভাল ফলাফল পাওয়া যায় না শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। গত তিন বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বকশীগঞ্জ সরকারি কিয়ামত উল্লাহ কলেজ ও খাতেমুন মঈন মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও আলহাজ গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন কলেজের কোন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় নি। এসব কলেজের শিক্ষকদের দাবি , বিভিন্ন চর এলাকা থেকে দুর্বল শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় তারা ভাল ফলাফল করতে পারছে না। কারণ তাদের ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল।

মেরুরচর ইউনিয়নের ফারাজিপাড়া গ্রামে রয়েছে শুধুমাত্র একটি টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজ। এই কলেজটিতে যেতেও একজন শিক্ষার্থী পাড়ি দিতে হয় ৫-৬ কিলোমিটার রাস্তা। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মেরুর চর ইউনিয়নে একটি বিএম কলেজ, চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় , দুটি দাখিল মাদরাসা রয়েছে। এই ইউনিয়নে গড় শিক্ষার হার ৩০ শতাংশ।

মেরুরচর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ ঘেষা এলাকা গুলোতে কোন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ নেই। এ কারণে এই ইউনিয়নের চরের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষায় অনেকটায় পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ, পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষার্থীরা যেমন উচ্চ শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি সামাজিক কুসংস্কার থেকে বের হতে পারছে না এই এলাকার মানুষ। ফলে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্য মানুষ গড়ে উঠেনি চরের পরিবেশে।

অপরদিকে সাধুরপাড়া ইউনিয়নে তিনটি উচ্চ বিদ্যালয় ও দুটি মাদরাসা রয়েছে। এই ইউনিয়নে কোন কলেজ নেই। ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কোন কলেজে পড়াশুনা করতে এই ইউনিয়নের শিক্ষার্থীদের। এই ইউনিয়নের শিক্ষার হার গড়ে ৩৩ শতাংশ।

তবে গ্রাম থেকে গ্রাম যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নদী ভাঙন রোধ, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা করা গেলে পাল্টে যেতে যেতে এই চরের দৃশ্যপট। সরকারের সুনজর, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরদারি থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে পারে।

এ বিষয়ে মেরুরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম জেহাদ জানান, মেরুরচর একটি  দারিদ্র ,নদী ভাঙন ও বন্যা কবলিত এলাকা। এই এলাকার মানুষকে বৈরি পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। নদী ভাঙন, বন্যা,খরা, কৃষি পণ্যের বাজার সঠিক সম্প্রসারণের অভাবে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এই এলাকার ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।
তবে তিনি নিজ উদ্যোগে মাদারের চর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মাওলা নামে একটি কলেজ করার ঘোষনা দেন।

স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও সাবেক অধ্যক্ষ আফসার আলী শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে বলেন , আমাদের চরের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় সমস্যা হচ্ছে দক্ষ শিক্ষকের অভাব। এছাড়াও অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়া, বিদ্যালয় পরিচলনা কমিটিতের অযোগ্য লোকদের কর্তৃত্ব। তিনি এর থেকে বের হতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের জাগ্রত হওয়া শিক্ষা বিষয়ক সভা সেমিনার করার পরামর্শ দেন। অনেক বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ডিজিটাল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা ।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, দারিদ্রতা, বাল্যবিবাহ, নদী ভাঙন সহ নানা কারণেই চরের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ভাল মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় মানম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। চরের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করে শিক্ষার দিকে নজর দিলেই অনেকটায় উপকারে আসবে।

বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই। যে শিক্ষা প্রকৃতভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের উপকারে আসবে সেই শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষক, অভিভাবক, সুধী মহল সহ সকলের সচেতনতা প্রয়োজন। মানুষকে অন্য দিকে চিন্তা করে ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকেই নজর দেয়া উচিত।


⇘সংবাদদাতা: জিএম ফাতিউল হাফিজ বাবু

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top