মো. শাহ্ জামাল ॥ জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কৃতি সন্তান ও জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. হিমাংশু চন্দ্র পাড় ১১ মার্চ রাত ১১টার বারইপাড়ার নিজবাড়িতে মৃত্যুবরণ করেছেন। (দিব্যান লোকান স্বগচ্ছতু) কয়েকদিন আগে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সোমবার বেলা ১১টার দিকে হিমাংশু পাড়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। একাধারে তিনি রাজনীতিক-সমাজসেবক এবং শিক্ষানুরাগি ছিলেন। তিনি বাঘাডোবা হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্নমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
বাবু হিমাংশু পাড় ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মেলান্দহ বারইপাড়া গ্রামে মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম সুধীর চন্দ্র পাড় ও মাতার নাম দুলু রাণী পাড়। তিনি ১৯৬৬ সালে হুনুমানতলা প্রবর্তক প্রাথমিক বিদ্যালয় (বিদ্যাপীঠ) থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি, মেলান্দহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮০ সালে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন। বারইপাড়া গ্রামের ইতিহাসে তিনিই দ্বিতীয় সারির গ্রাজুয়েট। প্রথম গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী অর্জন করেন-উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বর্গীয় বাবু রেবতী মোহন কর। ১৯৮৮ সালে বাঘাডোবা নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষককালে তিনি ময়মনসিংহ টিবি কলেজ থেকে বি-এড কোর্স সমাপ্ত করেন। ১৯৯৬ সালে সরিষাবাড়ী হোমিও মেডিকেল কলেজ থেকে ডি-এইচ এম এস কোর্স সমাপ্ত করে হোমিও চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন:
হিমাংশুপাড় ১৯৭৭ সালে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে মেলান্দহ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৯ সালে মেলান্দহ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে সিপিবি ৪র্থ কংগ্রেসে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। পার্টির দায়িত্ব গ্রহণের পর উপজেলা পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্ষেত মজুর সমিতি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি হলে ক্ষেত মজুরদের গম চুরির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মেলান্দহ উপজেলা পর্যায়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সালে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে মেলান্দহ উপজেলায় প্রথম বিজয় মিছিলের নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল (বর্তমানে মেলান্দহ বিএনপি’র সভাপতি)সহ অন্যান্যদের এক বিরাট গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন ।হিমাংশুপাড় ছাত্র জীবন থেকেই বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত আজীবন বিপ্লবী কমরেড রবি নিয়োগী মন্মথ নাথ দে, মোয়াজ্জেম সরকার, শাহনেওয়াজ এমপি, দীপেন বসাক প্রমুখ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে রাজনৈতিক শিক্ষা নেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ক্ষেত মজুর সমিতি, কৃষক সমিত গড়ে তোলার কাজে অংশগ্রহণ করেন। তাছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে নারীনির্যাতন, ধর্ষন, খাস জমি ভূমিহীনদের প্রদান ও গম চুরি ও ঘুষ দুর্নীতি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৬৯ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আইয়ুব ইয়াহিয়া বিরোধী গণঅভ্যূত্থানে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহের কাজে সহযোগিতা করেন। এজন্য তাঁকে মে মাসে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে পাঁচশত টাকার বিনিময়ে মুক্তি পান। ওই রাত ১২টায় গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে রাতারাতি বন্দরৌহা গ্রামে বন্দালী মন্ডলের বাড়ী থেকে নৌকায় মহেন্দ্রগঞ্জ পাড়ি জমান। শহীদ শামস উদ্দিন সমর ছিলেন তাঁর সহপাঠি। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিষ্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছেন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড:
১৯৭৭-৭৮ সালে সাহিত্য প্রেমিকদের নিয়ে “সন্ধানী সাহিত্য পরিষদ” নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তৈয়ব আলী স্যারের সহায়তা ও বুদ্ধি পরামর্শেক্রমে বন্ধুবর নজরুল ইসলাম দুলাল, মুন্সি মাজহার বাদশা আরও অনেকে সন্ধানী সাহিত্য পরিষদ পরিচালনা করতেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে দেয়াল পত্রিকা, কবিতা পাঠ, মাসিক ম্যাগাজিন ও সংকলন নিয়মিত প্রকাশিত হতো।মেলান্দহ উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরী পরিচালনা:
দেশ স্বাধীনের পর সরকারি সহযোগীতায় উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তৎকালীন ইউএনও বজলুর রহমান ভূইয়া, বর্তমান পৌরসভা কার্যালয় শিল্পকলা একাডেমিতে একটি পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বদলী হয়ে যাবার পর লাইব্রেরীটি পরিচালনায় আর্থিক সংকটে পড়ে। পরবর্তীতে সুধী জনের সাথে আলাপ আলোচনা ও সক্রিয় উদ্যেগে লাইব্রেরীটি পুনরায় পরিচালনায় একমত হয়। পরে একটি সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কিসমত পাশা (প্রাক্তন চেয়ারম্যান)কে আহ্বায়ক করে নতুন কমিটি গঠিত হয়। আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ যোগাযোগ ও পাঠক সৃষ্টি এবং বৃক্ষ রোপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। পরে তিনি লাইব্রেরী পরিচালনার কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিটিতে বিনা প্রাতিদ্বন্দিতায় শ্রদ্বেয় শিক্ষাগুরু জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের প্রাক্তণ অধ্যক্ষ সুজায়াত আলী মিয়াকে সভাপতি হিমাংশু পাড় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।নিম্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা:
১৯৮৬ সালে পশ্চিম বাঘাডোবা (আলাইরপাড়) গ্রামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি বাজার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে গণ্যমান্য মুরুব্বী ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে বাঘাডোবা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জানুয়ারী মাসেই আলাইরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক সাহেবের সহযোগিতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গৃহে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি শুরু হয়। বিএনপি নেতা মোস্তাফিজু রহমান বাবুলের পিতা প্রয়াত আব্দুল হাই জামালী ইউপি চেয়ারম্যান এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। আব্দুল হাই জামালী ছাড়াও স্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন-প্রয়াত ওসমান আলী মন্ডল, ছুবাহান মন্ডল, আব্দুল মালেক, তৈবর আলী, ছুরতুজ্জামান মাস্টার, প্রামানিক, তোরাব আলী প্রামানিক, আব্দুল মজিদ মন্ডল, জলহক মন্ডল, জাহের উদ্দিন, ছাহের উদ্দিন আব্দুল হক মন্ডল, দুদু মন্ডল, আয়েন উদ্দিনমোলভী, আলকাস মোলভী, আবু সাঈদ খাঁন, খোঁকা মন্ডলসহ এলাকার অনেকেই। স্কুলের সহকারি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রয়াত ওসমান গণি চৌধুরী মজনু, জহুরুল হক, মোয়াজ্জেম হোসেন, শেফালী আক্তার ও বাদল ফকির। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম খোকা এমপি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম সরকারি অনুদান হিসেবে ১০ বান্ডেল টিন ও ৬০ হাজার টাকা নগদ প্রদান করেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে সহকারী শিক্ষক ও এলাকাবাসী মিলে গ্রামে গ্রামে ধান, চাউল সংগ্রহ করে বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে স্কুলটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।হিমাংশু পাড় ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত জামালপুরের একটি এনজিওতে যোগদান করেন। ২০০০-২০০১ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (সমাজ প্রগতি সংস্থা) প্রগ্রাম কো-অডিনেটর এর দায়িত্ব পালন কালে ২০০০-২০০১ সালে সরকারি অনুদানে মেলান্দহ থানার আদ্রা ইউনিয়নে পশ্চিম আদ্রা গ্রামে ও ঝাউগড়া ইউনিয়নের ইন্দ্রবাড়ী গ্রামে বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। বর্তমানে বিদ্যালয় দুইটি সরকারিকরণ করা হয়েছে ।
⇘সংবাদদাতা: মো. শাহ্ জামাল
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।