যে ক্রীতদাসী হয়ে ওঠেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী

S M Ashraful Azom
0
The slave who became the most powerful woman
সেবা ডেস্ক: তিনি ছিলেন একজন ক্রীতদাসী। এই ক্রীতদাসীই এক সময় হয়ে গেলেন ক্ষমতাধর নারী। যাকে আমরা ‘হুররাম’ নামেই সবাই চিনি। এখন নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন কার কথা বলছি! হ্যাঁ, তিনিই সুলতান সুলেইমানের হুররাম। যদিও তার নাম হুররাম ছিলো না। সুলতান সুলেইমান তাকে ভালোবেসে এই নামে ডাকতেন। হুররাম নামের অর্থ ‘যে আনন্দ দেয়’। সত্যিকারার্থেই তিনি জয় করতে পেরেছিলেন সুলেইমানের মন। তার আগমন এমনকি বদলে দিয়েছিলো সুলেইমানের জীবনের মোড়টাই।

নাটকীয় উত্থানে ভরা হুররামের জীবন- ভাগ্যাহত ক্রীতদাসী, এরপর সুলতানের হারেমে ঠাঁই, দুইশ' বছরের অটোমান ঐতিহ্য ভঙ্গ করে সুলতানের সঙ্গে বিয়ে। অতঃপর সেই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীতে পরিণত হওয়া। আজও ইতিহাসবিদ, লেখক ও সাধারণ মানুষের কাছে তার জীবনী সেই একই রকম আবেদনময়।

সুলেইমান যখন হুররামের দেখা পেলেন

সুলতান প্রথম সুলেইমানকে মানা হয় অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে যোগ্য আর জনপ্রিয় শাসক। তার শাসনের প্রভাব ছড়িয়ে গিয়েছিলো ইউরোপের বহু দেশে ও মধ্যপ্রাচ্যে। সুলতান হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৫২০ সালে। এরপর অটোমান সাম্রাজ্যের ভার তার উপর ন্যস্ত করা হয়। আর ঠিক এমন সময়ই তিনি দেখা পান হুররামের। তার আসল নাম ছিল রোজালিনা, ছোট করলে রোজ। হুররাম জন্ম নিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রা লিসোস্কা নামে পোল্যান্ডের ছোট একটি শহর রোহাতিনের এক অর্থোডক্স পাদ্রি পরিবারে। বর্তমানে যেটি পশ্চিম ইউক্রেনের একটি অংশ। ১৫২০ সালে ক্রিমিয়ান তাতাররা এই অঞ্চলে আক্রমণ করে এবং সবার সঙ্গে হুররামকেও ক্রীতদাসী হিসেবে বন্দি করে। তাকে ক্রিমিয়ায় ক্রীতদাস বেচাকেনার বাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে, অন্য ক্রীতদাসদের সাথে তাকে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে অটোমান সুলতানের ব্যক্তিগত হারেমের জন্য তাকে কিনে নেয়া হয়।

তার বয়স তখন সবে পনের বছর। হারেমে জায়গা হওয়ার কয়েক মাসের ভেতর হুররাম সুলেইমানের নজরে চলে আসেন। তার নজরকাড়া সৌন্দর্য, মনভোলানো হাসি আর বুদ্ধিমত্তা সুলতানের মন জয় করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। হুররাম যতই সুলেইমানের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠছিলেন, ততই হারেমে তাকে হিংসা করার মতো নারীর সংখ্যা বাড়ছিলো। হুররামও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে হুররামের প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা বাড়ছিল। তাদের মাঝে অন্যতম ছিল মাহিদেভরান সুলতান। যিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মুস্তাফার মা ছিলেন। হারেমের ভেতর হুররামের প্রতিদ্বন্দ্বীরা মিলে মাহিদেভরানের নেতৃত্বে আক্রমণ করে বসে তার ওপর। বুদ্ধিমত্তা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হুররাম সেসব আক্রমণ প্রতিহত করেন।

অটোমান নিয়ম অনুযায়ী সুলতানদের বেশ কিছু উপপত্নী থাকত, যারা কেবল একটিমাত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারত। সন্তান জন্মের পর তাদেরকে সন্তানসহ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে পাঠিয়ে দেয়া হতো। একটিমাত্র সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকার বেঁধে দেয়া হয়, যাতে উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের মৃত্যু না ঘটে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এরকম পরিস্থিতিতে অটোমানরা বারবার পড়েছে। যার কারণে সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত হুমকির মুখোমুখি হয়েছিল। সুলেইমানের দু‘জন উপপত্নী ছিলেন- গুলফাম ও মাহিদেভরান। কিন্তু হুররামের বেলায় এসে সুলেইমান সাম্রাজ্যের দুইশত বছরের নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে বিয়ে করেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উপপত্নীরা একটিমাত্র সন্তান জন্ম দিতে পারলেও হুররাম ছিলেন ছয় সন্তানের মা। তাদের ভেতর একজন ছিলেন মেয়ে। সবার বড় ছিলেন মেহমুদ, যার জন্মের পর সুলতান হুররামকে হাসেকি সুলতান নাম দিয়ে সম্মানিত করেন, যার অর্থ শাহজাদার মা। মেহমুদের জন্মের পর সন্তানদের নাম যথাক্রমে মিহিরমা সুলতানা, শাহজাদা আবদুল্লাহ, শাহজাদা সেলিম-২, শাহজাদা বায়েজিদ ও শাহজাদা জাহাঙ্গীর।

পূর্বে হুররাম ছিলেন অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সুলতানের সঙ্গে বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। বিয়ের পর হুররাম সুলতানের কাছে নিজেকে একজন কৃতদাসী স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। কৃতদাসী হিসেবে সুলতানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে থাকাটাকে নিজের জন্য অপমানজনক ভাবছিলেন তিনি। সুলতানকে এ ব্যাপারে অনুযোগ করেন হুররাম। স্ত্রী হিসেবে সেটা হুররামের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক ছিল। সুলতানও বিষয়টি অনুধাবন করে তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন। এই বিয়ে এবং সুলতানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে অল্প সময়ের ভেতর হুররাম প্রাসাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠেন। শুধু স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদার জোরে নয়, হুররামের বুদ্ধিমত্তার জন্যই সম্ভব হয়েছিলো সেটি। প্রাসাদে জায়গা পাওয়ার পর থেকেই তিনি তুর্কি ভাষা ও ব্যাকরণে দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন। রাজপ্রাসাদের নিয়ম-কানুন ও সামাজিকতার মতো বিষয়গুলো সহজেই আয়ত্ত করে নেন হুররাম। যার কারণে সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুলতানের চোখে নিজেকে আরও যোগ্য করে নেন তিনি।

ইউরোপের ডাইনী!

অটোমান রীতিনীতিতে এর আগে কোনো নারী সুলতানের এতটা কাছাকাছি আসতে পারেনি! তাই হুররাম আর সুলেইমানের সম্পর্কের ব্যাপারে সাম্রাজ্য জুড়ে কথাবার্তা চলতে থাকে, তাদের কাছে এমন ঘটনা ছিল অপ্রত্যাশিত এবং নজিরবিহীন। সুলতান সুলেইমানই একমাত্র সুলতান, যিনি কেবল একজন নারীর প্রতিই বিশেষ ভাবে দুর্বল ছিলেন। হুররাম নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করে নিয়েছিলেন। অটোমানদের ভাষা, ব্যাকরণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল এবং কূটনীতি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। অপরূপ সৌন্দর্য আর মেধার জোরে তিনি সুলতানের ব্যক্তিগত পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পান।

হুররামের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে ১৫৪৯ সালে পোল্যান্ডের নতুন রাজা সিগমুন্ড অগাস্টির সিংহাসনে আরোহণকে অভ্যর্থনা জানিয়ে লেখা পত্রের মাধ্যমে। সাম্রাজ্যজুড়ে গুজব ছড়াতে থাকে, হুররাম একজন ডাইনী! এই ভিনদেশী নারী সুলতানের উপর কালো জাদু করেছেন। যার কারণে সুলতান নিজে থেকে কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এই গুজবের খবর সুলতানের কানে পৌঁছানো মাত্র তিনি রাজ্যের বহু মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেন। যাদের ভেতর পরিবার এবং রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ লোকজন ছিলেন। এতে করে হুররামের প্রতি সুলতানের ভালোবাসার মাত্রা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সবার কাছে।

জনদরদী হুররাম সুলতান

সাম্রাজ্যব্যাপী অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, ঝর্ণা এবং কনস্টান্টিনোপলের দাস বিক্রির বাজারের পাশে নারীদের জন্য হাসপাতাল স্থাপন করেন হুররাম। এছাড়াও ‘হায়া সোফিয়া’ এবং সুলতানের মসজিদের ইবাদতখানার জন্য উন্নত হাম্মামখানা স্থাপন করেন, যেগুলোতে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। ১৫৫২ সালে জেরুজালেমের অদূরে একটি সূপের রান্নাঘর তৈরি করেন, যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ জন দরিদ্র জনগণের দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো, আশপাশের লোকজনও আসতো এখানে খাওয়ার জন্য।

১৫ এপ্রিল ১৫৫৮ সালে হুররাম অজানা এক রোগে মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তার খাদ্যনালীতে আলসার হয়েছিল। সুলতান সুলেইমানের ব্যক্তিগত মসজিদের অন্তর্ভুক্ত সমাধিকেন্দ্রে সুলতান হুররামকে সমাহিত করা হয়। হুররামের মৃত্যু সুলতান সুলেইমানকে একাকী করে তোলে। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। যার প্রভাব সাম্রাজ্যের উপরও পড়েছিল। সুলেইমান নিজে হুররামের কাছে খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন, যা টিকে ছিল তার মৃত্যুর পরও। অবশেষে হুররামকে হারানোর ৮ বছর পর সুলতান সুলেইমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুলতান সুলেইমানকে সুলতান হুররামের পাশে সমাহিত করা হয়।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top