হলি আর্টিজান হামলার ৩ বছর

S M Ashraful Azom
0
হলি আর্টিজান হামলার ৩ বছর
সেবা ডেস্ক: ২০১৬ সালের ১ জুলাই। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গির আকস্মিক বর্বরোচিত হামলায় নিহত হন ১৭ বিদেশির পাশাপাশি বাংলাদেশের দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন।

স্বপ্নবাজ এ মানুষের স্বপ্নগুলোকে শেষ সম্বল মনে করে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, ওরা শহীদ, ওদের জন্য আমরা গর্বিত। তবে এও বলছেন, আর যেন এমন নারকীয় ঘটনা না ঘটে। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।

১৯ বছর বয়সী অবিন্তা কবিরের প্রাণ কেড়ে নিলেও তার স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারেনি জঙ্গিরা। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরের স্বপ্নপূরণে চালু হয়েছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। অবিন্তার শোকসন্তপ্ত পরিবার জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়ার পর খুঁজে পায় তার একটি ডায়েরি।

যেখানে অবিন্তা লিখেছিলেন একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করে দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছের কথা। যে ইচ্ছার কথা মায়ের কাছেও বলেছিলেন অবিন্তা। পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৬ সালের ২৭ জুন দেশে আসেন অবিন্তা।

১ জুলাই ছিল ২৫ রমজান। সেদিন ইফতারের পর দুই বন্ধু ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও তারুশি জৈনের সঙ্গে দেখা করতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যান অবিন্তা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই রেস্তোরাঁটিতে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক জঙ্গি।

এরপর সেখানে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদেরই একজন ছিলেন অবিন্তা। অবিন্তা এলিগ্যান্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহমেদ ও ইহসানুল কবিরের মেয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।

সেখান থেকে এ বছর (২০১৯ সালে) তার গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কথা ছিল। অবিন্তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ২০১৭ সালের ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। অবিন্তার নানি নিলু রওশন মোরশেদ যুগান্তরকে বলেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছিল অবিন্তা। সবসময় সে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পক্ষে কথা বলত। অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন করা হয়েছে তার স্বপ্নপূরণের জন্যই।

মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই তরুণীকে হারিয়ে পরিবারে যে শোক ছড়িয়েছে, তা সরেনি আজও। অবিন্তার স্বজনরা জানিয়েছেন, অবিন্তার মা সময় পেলেই মেয়ের রুমে যান, সেখানে তার চেয়ারে বসেন। নিজে নিজেই অবিন্তার সঙ্গে কথা বলেন। অবিন্তার জিনিসপত্র ধরে দেখেন।

অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, অবিন্তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলার বিষয়ে কাজ করছে সংগঠনটি। বৃদ্ধাশ্রম গড়াসহ সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের জন্য আবাসিক স্কুল, বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে ফাউন্ডেশন থেকে। অবিন্তা কবিরের স্বপ্নপূরণে রাজধানীর ভাটারার ১০০ ফিট এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে অবিন্তা ফাউন্ডেশন। স্কুলটিতে রয়েছে ৮০ শিক্ষার্থী।

অবিন্তা কবিরের স্মৃতি সংরক্ষণে এবং চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও অনুষদ সদস্যদের ব্যবহারের জন্য একটি সাইবার সেন্টার ও আর্কাইভ চালু করেছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। এটি ২০১৭ সালের ২৪ মে চালু করা হয়। এ সাইবার সেন্টারের নামকরণ করা হয় অবিন্তা কবিরের নামে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিদের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলি আর্টিজানে ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় নিহত হন তিনি। তখন তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। রবিউলের মৃত্যুর পর তাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয়েছে রায়না। তাদের বড় ছেলের নাম সামি। তার বয়স এখন ১০ বছর। তারা এখন বাবাকে খোঁজে। রবিউল মানিকগঞ্জে চালাতেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান। নাম তার ‘ব্লুমস’।

সেই প্রতিষ্ঠান আঁকড়ে ধরে পরিবার তার মধ্যে রবিউলের স্মৃতি খুঁজে পায়। রবিউল মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও গ্রামে গিয়ে গরিব শিশুদের ঈদের জামা দিয়ে এসেছিলেন। এখন স্ত্রী উম্মে সালমা ও রবিউলের পরিবার ওই দাতব্য প্রতিষ্ঠান দেখভাল করছে। রাবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা বলেন, মানুষটা মারা গেছে। কিন্তু রেখে গেছে অনেক স্মৃতি। সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছি আমরা। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রবিউলকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।

সেদিন নিহত পুলিশের গুলশান থানার ওসি সালাউদ্দিন খানের স্ত্রী কিম খান বলেন, দুই সন্তান নিয়ে আমাদের সুখের সংসার ছিল। কিন্তু সেদিনের ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় স্বামীকে হারিয়েছি। সন্তানরা হারিয়েছে বাবাকে। আমি যতই ছেলেমেয়েকে বুকে আগলে রাখি না কেন, তারা সব সময় বাবার কথা বলে। আসলে বাবার জায়গা মা পূরণ করতে পারে না।

বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মেয়ে সিমিন হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে ফারাজ দ্বিতীয়। ফারাজ সেই রাতে খাওয়াদাওয়া করতে ওই রেস্টুরেন্টে যাওয়ায় নিহত হন। ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজও করেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে লেখাপড়া করতেন।

তার স্মৃতি রক্ষায় ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয় ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। মানুষের কল্যাণে কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন। ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার বিতরণ, উত্তরবঙ্গে শীতবস্ত্র বিতরণ, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ত্রাণ বিতরণ, দুস্থ শিশুদের জন্য বিনামূল্যে চক্ষুশিবির পরিচালনা, দুস্থ রোগীদের জন্য ডায়াবেটিস পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি আরও অনেক সামাজিক কাজ করছে এই ফাউন্ডেশন।

ফারাজের বন্ধু ইশরাত আখন্দও এ রাতে নিহত হন জঙ্গিদের হাতে। নিহত ইশরাত আখন্দ ডেক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ছিলেন। হলি আর্টিজানের হামলার রাতে মারাত্মক আহত হন ডিশ ক্লিনার জাকির হোসেন শাওন। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ছেলে হারানোর বেদনায় এখনও কাতর তার পরিবার। শাওনের মা মাকসুদা খাতুন সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে নিজের চোখই হারাতে বসেছেন।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top