যে শর্তগুলো না মানলে কোরবানি বিশুদ্ধ হয় না

S M Ashraful Azom
0
If the conditions are not fulfilled then the sacrifice is not pure
সেবা ডেস্ক: আমাদের ইসলাম ধর্মে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
কোরবানি যেন একমাত্র মহান রাব্বুল আলামিনকে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশেই হয়। অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন মুখ্য না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে তা আল্লাহর কাছে কোরবানি গৃহীত হবে না।

মুসলিমের জীবনে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য অর্থকড়ি হালাল হওয়া আবশ্যক। হারাম অর্থ দিয়ে ইবাদত শুদ্ধ হয় না। হারাম অর্থে সওয়াবের আশা করাও গুনাহর কাজ। হালাল অর্থ দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ছোটখাটো পশুর ব্যবস্থা করেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ

‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা: হজ, আয়াত: ৩৭)।

এছাড়াও অংশীদারদের কারো নিয়ত যদি পরিশুদ্ধ না থাকে কিংবা কারো অর্থ যদি হালাল না হয়, তাহলে অন্য অংশীদারদের কোরবানিও নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যাচাই-বাছাই করে অংশীদার নির্বাচন করা চাই।

মানুষকে নিজের ধনাঢ্যতা দেখাতে ও বিত্তের মহড়া দেয়ার জন্য অনেকে কোরবানি দেন। কিন্তু এভাবে কোরবানি দিলে কোরবানি আদায় হবে না। নিদেনপক্ষে গোশত খাওয়া হয়। উপরন্তু এটি নিন্দনীয়, দৃষ্টিকটুও বটে।

কোরবানির পশুর বয়সসীমা যেমন হতে হবে:

 ঈদুল আজহায় উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া কোরবানি করা যায়। তবে এসব পশুর একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা রয়েছে। সে অনুযায়ী বয়স না হলে, এগুলো জবাই করলে কোরবানি হবে না।

উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে এক বছরের মতো মনে হয়, তাহলে কোরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে ৬ মাস হতে হবে।

ছাগলের বয়স এক বছরের কম হলে, কোনো অবস্থাতেই ওই ছাগল দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। (ফাতাওয়া কাজিখান, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২০৫-২০৬)।

কোরবানির পশুর ভাগ:

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েজ। অর্থাৎ কোরবানির পশুতে এক সপ্তমাংশ বা এর অধিক যে কোনো অংশে অংশীদার হওয়া জায়েজ। এক্ষেত্রে ভগ্নাংশ-  যেমন, দেড় ভাগ, আড়াই ভাগ, সাড়ে তিন ভাগ হলেও কোনো সমস্যা নেই।  (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)।

পশুর যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেয়া যাবে না:

কোরবানির পশু হতে হবে দোষত্রুটিমুক্ত। পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেয়া যাবে না, সেগুলো হচ্ছে : ১. দৃষ্টিশক্তি না থাকা, ২. শ্রবণশক্তি না থাকা, ৩. অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া, ৪. এই পরিমাণ লেংড়া যে জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম, ৫. লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা, ৬. জন্মগতভাবে কান না থাকা, ৭. কানের বেশির ভাগ কাটা, ৮. গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া, ৯. পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া, ১০. বেশির ভাগ দাঁত না থাকা, ১১. রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া, ১২. ছাগলের দুটি দুধের যেকোনো একটি কাটা, ১৩. গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনো দুটি কাটা। মোট কথা, কোরবানির পশু বড় ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। যেমন হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্ধ—যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত—যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু—যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত- যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৪)।

যেসব ত্রুটি থাকলেও কোরবানি দেয়া যাবে:

সেগুলো হচ্ছে : ১. পশু পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমতো খায়; ২. লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে বেশির ভাগ অংশ আছে; ৩. জন্মগতভাবে শিং নেই, ৪. শিং আছে, তবে ভাঙা; ৫. কান আছে, তবে ছোট; ৬. পশুর একটি পা ভাঙা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে; ৭. পশুর গায়ে চর্মরোগ, ৮. কিছু দাঁত নেই, তবে বেশির ভাগ আছে। স্বভাবগত এক অণ্ডকোষবিশিষ্ট পশু; ৯. পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম, ১০. পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম। তবে উত্তম হচ্ছে ত্রুটিমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি দেয়া, ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি দেয়া অনুচিত।

কোরবানির গোশত বণ্টনরীতি:

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ

‘তোমরা তা হতে নিজেরা খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থকে খাওয়াও।’ (সূরা: হজ, আয়াত: ২৮)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির গোশত সম্পর্কে বলেছেন,

كُلُوا وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا

‘তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করো।’ (বুখারি, আসসাহিহ : ৫৫৬৯; মুসলিম, আসসাহিহ : ১৯৭১)

‘খাওয়াও’ বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্থকে দান করা ও ধনীদের উপহার হিসেবে দেয়াকে বুঝায়। কতটুকু নিজেরা খাবে, কতটুকু দান করবে আর কতটুকু উপহার হিসেবে প্রদান করবে এব পরিমাণ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তাই উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ দরিদ্রদের দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা মুস্তাহাব (উত্তম)।

কোরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। ‘কোরবানির গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না’এ মর্মে যে হাদিস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে।

তবে ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) এ বিষয়ে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংরক্ষণ নিষেধ হওয়ার কারণ হলো দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত সংরক্ষণ জায়েয হবে না। তখন ‘সংরক্ষণ নিষেধ’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর যদি দুর্ভিক্ষ না থাকে তবে যতদিন ইচ্ছা কোরবানিদাতা কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করে খেতে পারেন। তখন ‘সংরক্ষণ নিষেধ রহিত হওয়া’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে।’ (ফাতহুল বারি, ১০/২৮; ইনসাফ, ৪/১০৭)।

কোরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এমনকি এক জিলহজ থেকে আরেক জিলহজ পর্যন্তও সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। (আহমাদ, আলমুসনাদ : ২৬৪৫৮)।

কেউ চাইলে সে তার কোরবানির সম্পূর্ণ গোশতকে বিতরণ করে দিতে পাবে। আর তা করলে উপরোক্ত আয়াতের বিরোধিতা হবে না। কারণ, ওই আয়াতে খাওয়ার আদেশ হলো মুস্তাহাব বা সুন্নাত। সে যুগের মুশরিকরা তাদের কোরবানির গোশত খেত না বলে মহান আল্লাহ উক্ত আদেশ দিয়ে মুসলিমদেরকে তা খাবার অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ খাওয়া ওয়াজিবও বলেছেন। (ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম : ৩/২৯২-৩০০)।

কোরবানির গোশত হতে কাফিরদেরকে তার অভাব, আত্মীয়তা, প্রতিবেশী অথবা তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য দেয়া বৈধ। আর এটা ইসলামের মহানুভবতা।  (ইবনু কুদামা, আলমুগনি, ১৩/৩৮১)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা.) তার ইহুদি প্রতিবেশীকে দিয়ে গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন।  (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ : ১২৮) । ‘তোমরা মুসলিমদের কোরবানি থেকে মুশরিকদের আহার করিও না’-মর্মে যে হাদিস এসেছে সেটা সহিহ নয়।  (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৯১১)।

মূলত কোরবানি হলো আত্মত্যাগ, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যতার নাম। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যথাযথভাবে কোরবানি করার তাওফিক দিন। আমাদের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে দিন। আমাদের কোরবানিগুলো কবুল করে নিন।

কেরবানির দিন ও ক্ষণ:
 
কোরবানি কতদিন করা যায়?
কোরবানি জিলহজের ১০ থেকে শুরু করে ১৩ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত করা যায়। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ-

(ক) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

لِّيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ

‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ (সূরা হজ, আয়াত: ২৮)।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত ইবনু আব্বাস (রা.) বলেছেন যে, ‘এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায় কোরবানির দিন ও তার পরবর্তী তিনদিন।’ (আসকালানি, ফাতহুল বারি, ২/৫৬১)। অতএব এ দিনগুলো মহান আল্লাহ কোরবানির পশু যবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন।

(খ) জুবাইর ইবনু মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

وَكُلُّ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ ذَبْحٌ

‘আইয়ামে তাশরিকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়।’ (আহমাদ, আলমুসনাদ : ১৬৫০২)।

আইয়ামে তাশরিক বলতে কোরবানির পরবর্তী তিনদিনকে বুঝায়। সুতরাং এই তিনদিনও কোরবানি করা যাবে।

(গ) কোরবানির পরবর্তী তিনদিন সাওম পালন জায়েয নয়। হাদিসে এসেছে, ‘আইয়ামে তাশরিক হলো খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর জিকির করার দিন।’ এখান থেকেও বোঝা যায় যে, এ তিনদিন কোরবানি করা যাবে।

(ঘ) সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কোরবানির পরবর্তী তিনদিন কোরবানির পশু যবেহ করা যায়। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, আলি ইবনু আবি তালিব (রা.) বলেছেন, ‘কোরবানির দিন হলো ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিনদিন।’ অধিকাংশ ইমামদের মত এটাই। (ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মায়াদ, ২/৩১৯)।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top