চল‌ছে জোরদার কূট‌নৈ‌তিক তৎপরতা

S M Ashraful Azom
0
Strong diplomatic activity going on
সেবা ডেস্ক: দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর প্রচেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর এখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি দূর করার দিকেই নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। কূটনৈতিক বিশ্নেষকরাও বলছেন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি করানোর কাজটি সহজ হবে। প্রত্যাবাসনবিরোধীরাও আর অপপ্রচারে সফল হবে না। এ মুহূর্তে আস্থার ঘাটতি দূর করাই বড় চ্যালেঞ্জ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ সম্পর্কে বলেছেন, এটা এখন সবার সামনে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। প্রত্যাবাসন কার্যক্রম সফল করতে হলে এই আস্থার ঘাটতি দূর করার দায়িত্ব মিয়ানমারকেই নিতে হবে। তিনি আশা করেন, অচিরেই এ আস্থার ঘাটতি দূর করতে মিয়ানমার সরকার কার্যকর উদ্যোগ নেবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু সম্ভব হবে।

আস্থার ঘাটতি দূর করতে যত উদ্যোগ : জাতিসংঘ সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রাখাইন এখন রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য কতটা অনুকূল, তা স্পষ্ট করতে মিয়ানমারকে এর আগে কয়েক দফা বার্তা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বার্তাটি দেওয়া হয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। তবে মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এসব বার্তায় বলা হয়, রাখাইনে প্রবেশে মিয়ানমার সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়নি। এ কারণে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, স্বীকৃত মানবাধিকার সংস্থার কর্মী এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের রাখাইনে প্রবেশ সহজ করার অনুরোধ জানানো হয় বার্তায়। কিন্তু মিয়ানমার সীমিত আকারে একটি-দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের যাওয়ার সুযোগ দিলেও জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতকেও এখন পর্যন্ত রাখাইনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ফলে রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ চিত্র পাওয়া যায়নি।

জাতিসংঘ সংশ্নিষ্ট অন্য একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ নভেম্বরকে লক্ষ্যমাত্রা ধরে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়ার সময়ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রবল আস্থার সংকট ছিল। ফলে তখনও প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এবার ২২ আগস্টকে প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যমাত্রা ধরে মিয়ানমারের অনুমোদিত তালিকা অনুযায়ী তিন হাজার ৫৪০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু হয়। এখনও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সেই একই আস্থার ঘাটতি দেখা গেছে। এর আগে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালেও রোহিঙ্গারা স্পষ্ট করেই জানায় যে, তারা নেপিদোর বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছেন না।

সূত্র জানায়, রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে অস্বচ্ছতার সুযোগ নিয়েই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের গুজবের ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে। 'রাখাইনে এখনও যেসব রোহিঙ্গা আছে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে, সেখানে এখনও নির্যাতন চালানো হয়, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের বন্দি করে রাখা হবে'- এ ধরনের অনেক কথা এখনও ছড়ানো হচ্ছে। রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা ধরনের ভীতিকর তথ্যের কারণেই রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরতে রাজি হচ্ছে না।

দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনেও এই একই বক্তব্য এসেছে। তারা রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আগেই নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি ফেরতের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা এবং ২০১৭ সালের নিপীড়নের বিচারে চার দফা শর্ত জুড়ে দেয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও রাখাইনে রোহিঙ্গা নেতাদের সফরের ব্যবস্থা, সাংবাদিকদের সরেজমিন ঘুরে দেখার সুযোগ দেওয়া এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে রাখাইন সফর করে সেখানকার প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বেশ আগেই। তবে তা আমলে নেয়নি মিয়ানমনার। এবার এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হবে।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পর বেইজিং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। মূলত, এ কারণেই মিয়ানমার ২২ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করতে রাজি হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকারের সময় চীনের একজন প্রতিনিধিও ছিলেন। তিনিও রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক বক্তব্য এবং মিয়ানমারের প্রতি আস্থার ঘাটতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ঢাকার কূটনীতিকরা আশা করছেন, আস্থার ঘাটতি দূর করতে এবং রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র পেতে চীন আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আস্থার ঘাটতি দূর করার বিষয়টি মিয়ানমারের ওপর নির্ভর করে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে। তাই তারা আস্থার ঘাটতি দূর করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করি। রাখাইনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং রোহিঙ্গা নেতারা সফর করে পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেলে এবং তা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে অবহিত করলে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিজ দেশে ফেরার আস্থা তৈরি হবে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু করতে সম্ভব সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কারণ এ সংকটের বোঝা বাংলাদেশের পক্ষে বেশি দিন বহন করা সম্ভব নয়। এ সংকট দীর্ঘায়িত হলে তা এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং রোহিঙ্গারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিজের দেশে ফিরে না গেলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আজকে যে সুবিধা তারা ক্যাম্পে পাচ্ছে, সেটা দীর্ঘ সময় ধরে তারা পাবে না।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পর বেইজিং এ সংকট নিরসনে ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এখন রাশিয়ার ভূমিকা আরও সক্রিয় হলে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে। এ লক্ষ্য নিয়েই কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি দূর করতে সফল না হলে নানা গুজব, অপপ্রচার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বড় বাধা হয়ে থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা সফল না হলেও ভালো একটা শিক্ষা এখান থেকে পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর যে আস্থা নেই, সেটা স্পষ্ট হয়েছে। ফলে এখন সবার আগে আস্থার ঘাটতি দূর করার চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার লক্ষ্যই নিতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার আগে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য রাখাইনে দেখে এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের আস্থার সংকট অযৌক্তিক কিছু নয়। এখন সেই সংকট দূর করতে হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে হবে, তাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলতে হবে। আন্তরিক আচরণ এবং রোহিঙ্গাদের চাওয়ার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আস্থায় আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটা কমিশন হতে পারে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন মিয়ানমার কমিশন গঠনের অজুহাত সামনে রেখে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত করার সুযোগ না নেয়।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top