সেবা ডেস্ক: হিরোশিমা জাপানের একটি শহর। এটি হিরোশিমা জেলার প্রশাসনিক রাজধানী এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় হুনশু দ্বীপপুঞ্জের ছুগোকু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর। এ ছাড়া হিরোশিমা জাপানের সবচেয়ে বৃহৎ দ্বীপ। জাপানের বর্তমান রাজধানী টোকিও থেকে ৫০০ মাইল দূরত্বের শহর এটি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরমাণু বোমার বিধ্বংসী পরীক্ষা চালানো হয় এ শহরটির ওপর। তবে লক্ষ্য শুধু পরীক্ষাই ছিল না, পাশাপাশি গণনাতীত সংখ্যক মানুষকে হত্যার জন্যও বোমাটি ফেলা হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দেওয়া নামে নামাঙ্কিত পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’ হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয় হিরোশিমার ওপর। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমাবাসীর ওপর নেমে আসে এক মহাদুর্যোগ। এ দিনেই পৃথিবীতে প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হয়েছিল। জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা পথে নিরপরাধ লাখো মানুষের জীবনাবসান ঘটতে যাচ্ছে- এ খবর কেউ জানত না। প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপ ইতিহাস সৃষ্টি করল। লিটল বয়ের দৈর্ঘ্য ছিল তিন মিটার। বোমাটির মাথায় ছিল সাড়ে ১২ কিলোটন টিএনটি এবং এর ওজন ছিল ৩ হাজার ৬০০ কিলোগ্রাম। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ তিনিয়ান থেকে ইউএস বি২৯ (এনোলা গে) বিমানটি ব্যবহার করা হয়েছিল বোমা ফেলার জন্য। বিমানটির পাইলট হিরোশিমার ঘুমন্ত মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে প্যারাসুটে বেঁধে একটি বোমা নামিয়ে দিয়েছিল।
লিটল বয় মাটিতে পড়ার আগেই ভূমি থেকে ৫৮০ মিটার উঁচুতেই এটি বিস্ফোরিত হয়। ঠিক যখন বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তখন চতুর্পাশের তাপমাত্রা মুহূর্তের মধ্যে হয়েছিল ৭ মিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি। বোমা বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে ওই তাপমাত্রা ছড়িয়ে যায়, আর ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকা যাবতীয় সবকিছু মুহূর্তে গলে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নির্মমতার কথা জাপানিরা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। যেখানে লিটল বয় বিস্ফোরিত হয়েছিল সেটি সমতল জায়গা। নানা ধরনের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক দালান ছিল অগণিত। চতুর্পাশের প্রায় পাঁচ বর্গমাইল এলাকা চোখের পলকে ছাই হয়ে যায়। হিরোশিমায় বোমা হামলার প্রাথমিক ধাক্কাতেই কেবল ৭৬ হাজার দালান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরমাণু বোমার প্রত্যক্ষ আঘাতে প্রাথমিকভাবেই প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও বেসরকারি তথ্য মোতাবেক মৃতের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৮ হাজার ৬৬১।
১৯৪৬ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত প্রত্যক্ষ মৃত্যুর হিসাব রাখা হয়েছিল। এরপর হিরোশিমায় বোমার পরোক্ষ কারণে আরও লক্ষাধিক মানুষকে মরতে হয়েছে, যার সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন।
হিরোশিমা ট্র্যাজেডির ৭০ বছর পালিত হলো এ বছর। প্রতি বছরের মতো এবারও জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মর্মান্তিক ওই দিনটিকে স্মরণ করছে। দিনটি উপলক্ষে হিরোশিমার মেমোরিয়াল পার্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন দেশটির হাজারো বাসিন্দা। মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হয়ে রয়েছে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। মানুষ মারার এই অকল্পনীয় হাতিয়ার নিষিদ্ধকরণে সোচ্চার সচেতন মানুষরা। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকবে হিরোশিমা।
‘ফ্যাটম্যান’ নিশ্চিহ্ন করে দেয় নাগাসাকিকে
নাগাসাকি জাপানের একটি শহর। ১৬ শতকে পর্তুগিজ নাবিকরা জাপানি মৎস্যজীবী অধ্যুষিত এই দ্বীপে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন ঘটায়। ১৫৪৩ সালে নাগাসাকি দ্বীপটিতে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগিজদের পা পড়ে। ১৮৫৯ সালে নাগাসাকিকে উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বন্দরনগরী নাগাসাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে পরিণত হয়। কারণ, এ দ্বীপটিতে জাপানের রাজকীয় নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট বেলা ১১:০২ মিনিটে মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বিমান থেকে ফ্যাটম্যান নামের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। যার ফলে শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ধারণা করা হয়, এতে ৭০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়। নাগাসাকি কর্তৃপক্ষের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন। যার মধ্যে ২০০০ হাজার জন কোরিয়ান শ্রমিক ছিল। মাত্র তিন দিন আগে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের যে কলঙ্ক লেপন হয়েছিল মানব সভ্যতায়, তার সঙ্গে আরেকটি কলঙ্ক যোগ হয় এতে। ফ্যাটম্যানের কাছে অসহায় মানুষ আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পারমাণবিক বোমা কাউকে ক্ষমা করেনি। আকাশ থেকে ছুড়ে দেওয়ার পর মাটির কাছাকাছি আসতেই এটি বিস্ফোরিত হয়। আকাশ ফুঁড়ে ধোঁয়া ওঠে। মেঘ পেরিয়ে যাওয়া সেই বিস্ফোরণের দৃশ্য যে কাউকে আতঙ্কে নির্বাক করে দেবে।
অনুমান করা হয়, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যায়। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার লোক মারা যায় এবং পরবর্তীতে এ দুই শহরে বোমার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। জাপানের আসাহি শিমবুন পত্রিকার করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের পর জাপান বাধ্য হয় যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নিতে। জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে অধিকাংশের ধারণা এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়, যার ফলে পূর্ব-পরিকল্পিত জাপান আক্রমণ ‘ইনভেশন’ সংঘটিত হলে উভয় পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হতো, তা আর বাস্তবে ঘটেনি। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে এই বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। বিশেষ করে জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের সুদূরপ্রসারী ফল দেখতে পায় পুরো বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়। নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার স্মরণে নির্মিত হয়েছে নাগাসাকি পিস পার্ক। পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার নিয়ে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার বার্ষিকী প্রতি বছর পালন করে জাপানিরা।
পিস পার্ক স্থানটির কাছেই ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা হামলা হয়েছিল। সেই মহাদুর্যোগের সাক্ষী এটি। জাপানে একটি জাদুঘর করা হয়েছে যেখানে রাখা আছে হিরোশিমার কিছু ধ্বংসাবশেষ। পুড়ে যাওয়া একটি ট্রাই সাইকেল থেকে শুরু করে বেসামরিক মানুষের ঘরবাড়ির অনেক জিনিসপত্র! সবচেয়ে বিখ্যাত হল একটি হাত ঘড়ি যেটিতে সময় আটকে আছে সেই ভয়াল ৮:১৫ মিনিটেই…
লিটল বয় আর ফ্যাটম্যানের ধ্বংসলীলা
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে চমৎকার ঝকঝকে শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। লিটল বয় শীর্ষক বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছতে এটি সময় নেয় ৫৭ সেকেন্ড। এই সময়ে এটি অতিক্রম করে ৬০০ মিটার দূরত্ব। এ বিস্ফোরণটি ঘটে ১৩ কিলোটন (tnt)-এর সমান এবং সে সময় তাপমাত্রা হয়েছিল ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বিস্ফোরণের পর এক মাইল ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলা শুরু হয় এবং হিরোশিমার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনার পর ওই দিন বেলা ১১টায় হিরোশিমা শহরে দেখা গেল অসংখ্য মানুষের লাশ আর আহতদের চিৎকার? বোমা নিক্ষেপকারী পাইলট টিবেটস বিমান থেকে শহরের ভয়াবহ ধ্বংসের দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, হায় ঈশ্বর এ কি করলাম! হিরোশিমার ভয়াবহতার কারণ বুঝে ওঠার আগেই এর ঠিক তিনদিন পর জাপানেরই নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’-এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই কলঙ্কজনক ঘটনার নেপথ্যে ছিল অস্ত্রের উন্নয়নে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্লজ্জ অমানবিক প্রতিযোগিতা।-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।