
সেবা ডেস্ক: শুক্রবার কিংবা সোমবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন এলাকায় গেলে দেখতে পাবেন এক অন্য রকম পাঠশালা। সেখানে প্রায় শ খানেক ছেলেমেয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে খাতা-কলম হাতে বসে থাকেন। প্রচণ্ড রোদেও তাঁদের উৎসাহে ভাটা পড়ে না।
পাঠশালার নাম—মাল্টিপল ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আটটি ভিনদেশি ভাষা শেখা যাবে। মোট ৩০টা ক্লাস, ৬ মাসের কোর্স। প্রতি ক্লাস এক টাকা করে যার নিবন্ধন ফি মাত্র ৩০ টাকা! ৬ মাস পর উত্তীর্ণ হলে আরো ৬ মাসের কোর্স। সেখানে এই ৩০ টাকাও লাগবে না! আর এই টাকা কিন্তু খরচ হয় শব্দযন্ত্র, মাইক, বোর্ড আর মার্কারের পেছনে।
এই সংগঠনের মূল রূপকার ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ইসমাইল হোসেন সিরাজী। গতানুগতিক বিসিএস, ব্যাংক বা অন্য সরকারি–বেসরকারি চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি নিজে বেঁচে থাকতে চান ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে। একদিন তাঁর মনে হলো, আজ পর্যন্ত আমি যতটুকু শিখেছি, সেটাই নাহয় অন্যকে শেখাই। পোস্ট দিলেন ফেসবুকে, যারা ভিনদেশি ভাষা শিখতে চায় কিংবা শেখাতে চায়, তারা যেন পোস্টে কমেন্ট করে। সেই পোস্টে কমেন্ট পড়েছিল প্রায় ১৫০০!
সেখানেই পেয়ে গেলেন তাঁর মতো আরো আট–নয়জনকে। প্রত্যেকেই চান, যা-ই শিখেছি, যতটুকুই শিখেছি, অন্যকেও যেন তা শেখাতে পারি। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ল ভাষা শেখা ও শেখানোর মানসিকতা। এই সংগঠনে শেখানো হচ্ছে ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, চীনা, স্প্যানিশ, আরবি, জার্মান ও ফরাসি ভাষা। শিখছে প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী।
স্প্যানিশ ও জার্মান ভাষার প্রশিক্ষক আনিছুর রহমান বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা একই লক্ষ্যে সবাই ছুটতে থাকে। সরকারি চাকরির নেশায় পেয়ে বসে তাঁদের। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বরং অনেকে ভুগতে থাকেন হতাশায়। এ ধরনের মানুষদের ভিনদেশি ভাষা শিখিয়ে গতানুগতিক চাকরি ছাড়াও আরো নানা পথ দেখিয়ে দেয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
সংগঠনের চীনা ভাষার ইনস্ট্রাক্টর সুমন চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী হলেও শখের বশেই কনফুসিয়াস সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি বলেন, নিজে চীনা ভাষার প্রাথমিক অংশটুকু শেখা শেষ করেছি। এটুকুই অন্যদের শেখানোর চেষ্টা করছি। এই সংগঠন শুরুর আগে কনফুসিয়াস সেন্টারের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আমরা যদি একই ম্যাটেরিয়াল বা সিলেবাস ব্যবহার করি, তাহলে সেটা নীতিবহির্ভূত হবে কি না। তিনি বরং সানন্দে আমাকে সেগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেন।
এ তো গেল চীনা ভাষার কথা, বাকিগুলো? সে ক্ষেত্রেও তারা নিজেদের হাতে লেখা কোর্স ম্যাটেরিয়াল কিংবা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভাষা শিক্ষার বই ব্যবহার করে থাকেন।
প্রতি সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস। কেউ এক সপ্তাহে না এলেই তাঁর নাম কাটা! তাঁদের এক যুক্তি, ‘আমরা কাউকে জোর করে নিয়ে এসে শেখাচ্ছি না। যে আসবে, তার আগ্রহও তেমনই হতে হবে।’ সপ্তাহে দুদিনই তো মাত্র। এমনকি সাপ্তাহিক পরীক্ষার পাশাপাশি ৬ মাস পর তাঁরা যে ফাইনাল পরীক্ষাটা নেন, সেটায় পাস করতে হলে নাকি ৮০% নম্বর পেতেই হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই আবার ভাষা শিক্ষার ১০টি টিউটরিয়ালও বানাতে হয়। খুব সহজ নয় কিন্তু।
সিরাজীর পোস্টেই ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুমিত আল রশিদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘শুরু করো। আমি আসছি।’ সেই থেকে তিনি এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে যদি বলা হয়, এদের মার্কিং করতে, আমি ১০০ তে ১০০ দিতে বাধ্য। অল্প বয়সেই এত সুন্দর চিন্তা ও উৎসাহ এখন খুব কম মানুষেরই থাকে।’
ইংরেজির প্রশিক্ষক নাফিস বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই ক্লাস করার সুযোগ দিচ্ছি। আমাদের স্বপ্ন—দুই বছরের মধ্যে এটি দেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে যাবে। তারপর দেশের প্রথম ‘মাল্টি ল্যাংগুয়েজ লার্নিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠাই মূল উদ্দেশ্য।’ যেটাকে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে তাঁরা পরিণত করতে চান দেশের প্রথম মাল্টি ল্যাংগুয়েজ ইউনিভার্সিটি হিসেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আপাতত ভর্তির সুযোগ নেই। আবার আগামী জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় ব্যাচ শুরু হবে। বেতন নেই, ক্লাসরুম নেই, সুযোগ-সুবিধা নেই। তবু এই দলটি বাইরে থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে রাজি নয়। ‘যা করব, নিজেরাই করব’—এটাই তাঁদের প্রত্যয়।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।