
সেবা ডেস্ক: ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম গুটিকয়েক নীতি-নীতির নাম নয়, বরং তা মানুষের জন্য আল্লাহ প্রেরিত পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ। এতে ধর্ম-কর্ম, পারিবারিক, সমাজিক, শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এক কথায় মানবজীবনের যাবতীয় বিধি-ব্যবস্থা বিদ্যমান।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ইসলাম সম্বন্ধে আমাদের অনেকের ধারণা অনেকটা সাত অন্ধের হাতি দর্শনের ন্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নামাজ, রোজা প্রভৃতি কতগুলো বিশেষ বিশেষ ইসলামি ইবাদতের মধ্যেই ইসলামকে সীমাবদ্ধ মনে করছেন। আবার কেউ কেউ ইসলামকে কেবলমাত্র একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলাম কেবলমাত্র নামাজ রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আবার তা কেবলমাত্র একটি রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আবার তা কেবলমাত্র একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংজ্ঞাও নয়। বরং এটা মানব জীবনের পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ।
দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে যাদের ধারণা যেরূপ, তাবলিগে দ্বীন বা তাবলিগে ইসলাম সম্পর্কেও তাদের ধারণা ঠিক তদ্রুপ। এই জন্যই দেখা যায় যে, আমাদের সমাজে অনেকে তাবলিগে দ্বীন বলতে কেবলমাত্র কালিমা, নামাজ, ও রোজা প্রভৃতির প্রচারকে বুঝে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে দ্বীন ইসলাম যেমন ব্যাপক, তাবলিগে দীনও তদ্রুপ ব্যাপক। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন, সমাজ গঠন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্ত আল্লাহপাক যে সকল হুকুম আহকাম দিয়েছেন এদের সমষ্টির নাম হলো দ্বীন ইসলাম। আর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রচার কার্য চালানোর নাম হলো তাবলিগে দ্বীন বা ইসলাম প্রচার।
তাবলিগে দ্বীনের আবশ্যকতা:
তাবলিগে দ্বীনের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওই ব্যক্তির বাণীই সর্বোত্তম বাণী যিনি লোকদের আল্লাহ তায়ালার দিকে আহ্বান করেছে, নিজে নেক আমল করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, আমি একজন মুসলমান।’ সূরায়ে আসরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আসরের সময়ের কসম। যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে এবং ঈমান ও নেক আমলের তাবলিগ করেছে তারা ব্যতীত অন্যান্য সকল মানুষ নিশ্চয় ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ হজরত হুজায়ফা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা ইসলামের বিধি-নিষেধ জারি করতে থাকো। অন্যথায় অবিলম্বে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর ভীষণ আজাব নাজিল করবেন। তখন তোমাদের দোয়াও আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুল হবে না।’ (মিশকাত শরিফ)হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেছেন হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মানুষ যখন গুনাহের কাজ দেখেও তা দূর করতে চেষ্টা না করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর ব্যাপক বালা মুসবিত নাজিল করেন।
অন্য এক হাদিসে হজরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, তোমরা আমর বিল মারূফ করতে থাকো। অন্যথায় তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে খারাপ, আল্লাহ তায়ালা তাকে তোমাদের ওপর জয়ী করে দেবেন। তখন তোমাদের মধ্যে যিনি সর্বোৎকৃষ্ট লোক তার দোয়াও আল্লাহ কবুল করবেন না। (কিমিয়ায়ে সাআদাৎ)
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান সময়ে আমরা তাবলিগ প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। ফলে আমাদের ওপর হজরতের ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাপক বালা মুসিবত নাজিল হয়েছে এবং জালিম ও অত্যাচারীদের জুলুম ও অত্যাচার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাবলিগের প্রকারভেদ:
অবস্থার তারতম্য হিসেবে তাবলিগে দ্বীন দুই প্রকার-প্রথম প্রকার তাবলিগ ফরজে আইন। আল আওলাদ, পরিবার-পরিজন এবং অধীনস্থ ও অনুবর্তীগণকে ইসলামি জিন্দেগী যাপন করতে বাধ্য করা এবং এইভাবে সুযোগ-সুবিধা মতো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের আদর্শে গড়ে তুলতে প্রচার করা প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি অবশ্য কর্তব্য ফরজ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদরগণ! তোমরা নিজেরা দোজখের আগুন থেকে বাঁচ, আর তোমাদের আহাল (অর্থাৎ আল আওলাদ, পরিবার-পরিজন এবং অধীনস্থ ও অনুবর্তীগণ)-কেও দোজখের আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখো।’ কোরআন শরিফের অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুসলমানগণ! ‘তোমরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদেরকে বিশ্বমানবের উপকারের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। (বিশ্বমানবের উপকারের পথ এই যে,) তোমরা মানুষদেরকে ন্যায় ও ধর্মের কাজ করতে আদেশ দেবে এবং অন্যায় ও অধর্মের কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে।’
হজরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমার একটিমাত্র কথা জানা থাকলেও তা তোমরা আমার তরফ থেকে অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দাও।’ এ ধরণের তাবলিগকে বলা হয় তাবলিগে খাস। এটা সকলের প্রতি ফরজ।
দ্বিতীয় প্রকার তাবলিগ ফরজে কিফায়া। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তালিম-তালকিন, ওয়াজ-নসিহত, তাবলিগ-তাসনিফ প্রভৃতি কাজ ব্যাপকভাবে আঞ্জাম দেয়ার উদ্দেশ্যে একদল মুসলমানের প্রস্তুতি থাকা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ এইরূপ একটি জামায়াত প্রস্তুত না থাকলে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে একদল লোক এইরূপ প্রস্তুত থাকা দরকার: যারা লোকদের ন্যায়ের দিকে আহ্বান করবে, ভাল কাজ করতে আদশে করবে এবং অন্যায় ও অধর্মের কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে।’ এই ধরণের তাবলিগকে বলা হয় তাবলিগে আম। এটা সর্বসাধরণ মুসলমানের প্রতি ফরজ নয় এবং এটা তাদের পক্ষে সম্ভবপরও নয়। এটা ফরজে কিফায়া। এইজন্য একদল মুসলমানের প্রস্তুত থাকা কর্তব্য।
পূর্ব জমানার মুসলমানগণ এ পদ্ধতিতে তাবলিগে দীনের খেদমত করতেন। একদল মসুলমান এই উদ্দেশ্যে ওয়াকফ হয়ে যেতেন। তারা ওয়াজ নসিহত, তালিম-তাবলিগ, তাওয়াজ্জুহ, তালকিন, বিধর্মীদের সহিত মুনাজারা এবং দীনি কিতাবাদি প্রণয়ন করা প্রভৃতিকে জীবনের প্রধান কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করতেন।
অন্যান্য সর্ব সাধারণ মুসলমানগণ জীবিকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসা বাণিজ্য, কাজ-করবার, চাকরি প্রভৃতি হালাল পেশা এখতেয়ার করতেন সত্য, কিন্তু তারাও ফরজে আইন পরিমাণ তাবলিগে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিতে ত্রুটি করতেন না। নিজ নিজ অধীনস্থ ও অনুবর্তীগণকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতেন। এমনকি অবসর ও সুযোগ সুবিধা মতো ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে যার যতটুকু অভিজ্ঞতা ছিল অন্যান্য ভাইদের নিকট এর তাবলিগ করতেন।
প্রাথমিক যুগের সকল মুসলমানের দৃষ্টি তাবলিগে দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট ছিল বলেই অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র দুনিয়া ইসলামের উজ্জ্বল জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হতে পেরেছে। সেই যুগের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ইংরেজ মনীষী টমাস কার্লাইল লিখেছেন। ‘এই আরব জাতি, মানব মুহাম্মাদ, আর একটি শতাব্দি এ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। কিন্তু কী আশ্চর্য! বালিগুলো যেন বারুদে পরিণত হয়ে জ্বলে উঠল, আর তার অপূর্ব আলোকধারায় দিল্লি হতে গ্রানাডা পর্যন্ত সমগ্র জগৎ, সমস্ত আকাশ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল।
বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান জমানায় আমাদের সমাজের অনেকেই তাবলিগে খাস, যা প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি ফরজÑতা হতে গাফেল থেকে অনেক বড় গুনাহগার হচ্ছে। পক্ষান্তরে একদল লোক, যাদের মধ্যে তাবলীগে আমের যোগ্যতা নেই তারা তাবলিগে আমের জন্য বের হয়ে পড়ছে। তাদের দ্বারা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
তাবলিগের আদব:
তাবলিগে দীনের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার উদ্দেশ্যে তাবলিগের নিম্নলিখিত আদবসমূহের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা আবশ্যক। অন্যথায় অনেক সময় হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।১. খাস আল্লাহর ওয়াস্তে তাবলিগ করতে হবে। নফসের খাতিরে বা জেদের বশবর্তী হয়ে তাবলিগ করলে ফলপ্রসূ হয় না।
২. নিজের আমল মোতাবেক তাবলিগ করতে হবে। কেননা যে বিষয়ে নিজের আমল নেই সেই বিষয়ে অপরকে তাবলিগ করলে প্রায়ই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়।
৩. যার নিকট তাবলিগ করা হবে তার ইজ্জতের যেন কোনো প্রকার হানি না হয়। এর প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে।
৪. হিকমত ও উত্তম নসিহতের সাহায্যে তাবলিগ করতে হবে।
৫. তাবলিগ করতে নিম্নলিখিত হাদিস শরিফে বর্ণিত কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে।
অর্থাৎ ‘হজরত আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হজরত নবীয়ে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো শরিয়ত গর্হিত কার্যকলাপ দেখলে শক্তি থাকলে তা বলপ্রয়োগে বন্ধ করে দেবে। এতে অসমর্থ হলে মৌখিক প্রতিবাদ করবে। আর এতেও অসমর্থ হলে অন্তর দিয়ে উক্ত কাজকে ঘৃণা করবে। এবং এটা ঈমানের শেষ স্তর (অর্থাৎ যদি কেউ নাজায়েজ কাজের প্রতি অন্ততঃপক্ষে আন্তরিক ঘৃণাও পোষণ না করে, তবে সে ঈমানদার বলে গণ্য হতে পারে না)। তাবলিগে আমের উদ্দেশ্যে সফরে বের হতে হলে উপরে বর্ণিত শর্তসমূহের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।