![]() |
বুডিকা ও তার দুই কন্যার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য |
কথায় আছে, লাঞ্ছিত নারীর বিদ্বেষের চেয়ে সর্বগ্রাসী জগতে আর কিছুই হতে পারে না। প্রতিশোধপরায়নতার জের ধরে সে নরকের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে, ছারখার করে দিতে পারে সবকিছু। রোমান রাজত্বের বিরুদ্ধে রানী বুডিকার বুকে জ্বলছিলো এমনই প্রতিশোধের আগুন। রাজ্য হারানোর শোক, নিজ সন্তান, জাতির উপর নির্যাতন ও বঞ্চনার বেদনা, ক্ষোভের অঙ্গার হয়ে উঠেছিলো বুডিকার হৃদয়ে। শত্রুর জীবনের অমোঘ পরিণতি ও হারানো সাম্রাজ্য উদ্ধারের লক্ষ্যে উন্মত্ত প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বুডিকা।
![]() |
উন্মত্ত প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বুডিকা |
কিশোর বয়সেই বুডিকাকে কেল্টিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেকালে কেল্টিক নারীরা যুদ্ধময়দান ও রাজ্যশাসনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতেন। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও সমান পারদর্শী করে গড়া হতো তলোয়ার ও অন্যান্য অস্ত্র চালনায়। স্বাধীনতা ও অধিকারচর্চায় তৎকালীন কেল্টিক নারীরা অনন্য আসনে বিরাজমান ছিলেন। গ্রিক, রোমান ও অন্যান্য প্রাচীন সমাজের তুলনায় তারা অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন।
৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন দখল করে নেয় রোমানরা। বুডিকা তখনো প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। বেশীরভাগ কেল্টিক গোত্রকে বাধ্য করা হয় আত্মসমর্পণ করতে। ছিনিয়ে নেয়া হয় তাদের সকল ক্ষমতা ও অধিকার। তবে দুজন কেল্টিক রাজাকে রোমানরা তাদের অঞ্চলে সীমিত ক্ষমতায় ঐতিহ্যগত শাসন বজায় রাখার সুযোগ দেন। রাজারা তাদের জীবনকাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পান এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদের মৃত্যুর পর সে রাজত্ব রোমান শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়।
![]() |
কেল্টিক নারীরা যুদ্ধময়দান ও রাজ্যশাসনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতেন
|
এরই মধ্যে ৬০ খ্রিস্টাব্দে অতর্কিত পরিবর্তন আসে বুডিকার জীবনে রাজা প্রাসুটেগাসের মৃত্যুর ফলে। রাজা তার উইলে উত্তরসূরি হিসেবে স্ত্রী ও দুই কন্যার সাথে রোমান সম্রাট নিরোকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন। কিন্তু রোমান আইনে পুরুষ উত্তরাধিকারী ছাড়া ক্ষমতা লাভের নিয়ম ছিলো না। তাই রোমানরা জোর করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় রাজার উইল অগ্রাহ্য করে। জনসম্মুখে রানী বুডিকাকে চাবুকপেটা করে আর দুই কন্যাকে রোমান সৈনিকরা ধর্ষণ করে। রাজার আত্মীয় স্বজন ও উচ্চপদস্থ কর্মকতাদের দাস বানিয়ে রাখা হয়।
![]() |
রাজা প্রাসুটেগাস
|
বুডিকা তার দুই কন্যাকে নিয়ে নিজস্ব রথে চড়ে সৈন্য সংগ্রহ ও সাধারণদের উজ্জীবিত করতেন। সাধারণের সাথে তিনি মিশতেন সাধারণ হয়েই। সাবেক রানী হয়ে হারানো সাম্রাজ্যের ক্ষতিপূরণের আশা না করে একজন নির্যাতিত মা ও সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজের দুর্দশা তুলে ধরতেন মানুষের সামনে। রোমানদের বিরুদ্ধে জীবন পণ করে যুদ্ধে নামার প্রত্যয় ছড়িয়ে দেন সাধারণের মাঝে। তিনি মানুষকে বোঝান অন্যায়ের প্রতিশোধ হিসেবে তাদের কাজে দেবতারাও তাদের সমর্থন দিচ্ছেন।
![]() |
দুই কন্যাকে নিয়ে রথে চড়ে সৈন্য সংগ্রহ ও সাধারণদের উজ্জীবিত করতেন বুডিকা |
বুডিকার প্রথম আক্রমণ ছিলো কামুলোডানাম অর্থাৎ বর্তমান কোলচেস্টারে। রোমানরা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিন্ত ছিলো যে প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় আক্রমণের সুযোগ পায় বুডিকার সৈন্যদল। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকান্ড চালানো হয় সেখানে। তৎকালীন রোমান গভর্নর ছিলেন গায়েস সুয়েটনিয়াস পলিনাস। বুডিকার পরবর্তী আক্রমণ তাদের বাণিজ্য ঘাঁটি লন্ডনিয়াম (বর্তমান লন্ডন) বুঝতে পেরে সেখানে ছুটে যান সুয়েটনিয়াস। কিন্তু বুডিকার যুদ্ধপ্রস্তুতি ও ধ্বংযজ্ঞের কথা জানতে পেরে লন্ডনিয়ামকে বাঁচানোর আশা পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান।
![]() |
বুডিকার নেতৃত্বে কামুলোডানাম আক্রমণ করে সৈন্যবাহিনী
|
পরপর তিনটি শহর বিপর্যস্ত করে, রোমান সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে জয় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলেন রানী বুডিকা। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভুল। সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেয়া রোমানদের ধূর্ত চাল ছিল। নতুন করে রণকৌশল সাজাচ্ছিল রোমানরা।
![]() |
রোমান সৈন্যদের তাড়িয়ে জয় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলেন রানী বুডিকা |
![]() |
আহত বুডিকা |
বুডিকার সমাধিক্ষেত্র নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কারও মতে স্টোনহেঞ্জে তার সমাধিস্থল। আবার কেউ কেউ বলেন উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টিডের নরফোকে বুডিকার সমাধি রয়েছে।
যদিও অনেকদিন পর্যন্ত বুডিকার কীর্তি মানুষের কাছে অজানা ছিলো। ১৩৬০ সালে ট্যাসিটাসের বই ‘দ্য এনালস অফ ইম্পেরিয়াল রোম‘ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই বীরের আখ্যান মানুষ জানতে পারে। ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজের পাশে ১৯০৫ সালে বুডিকা ও তার দুই কন্যার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ স্বাধীনতার ইতিহাসে এই বীর যোদ্ধার নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।