ডব্লিউএইচও স্বীকৃত করোনা ভ্যাকসিনই কেবল নেবে বাংলাদেশ

S M Ashraful Azom
0
ডব্লিউএইচও স্বীকৃত করোনা ভ্যাকসিনই কেবল নেবে বাংলাদেশ


সেবা ডেস্ক: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃতিবিহীন করোনা ভাইরাসের কোনো টিকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শুরুতেই টিকা বিনা খরচে পাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে তা কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল বুধবার মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর সরকারের এসব সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি জানান, দেশে সবাইকে না পারলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

কভিড-১৯-এর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় টিকার দিকেই চেয়ে আছে বিশ^বাসী। রাশিয়া ও চীন ইতিমধ্যে টিকা তৈরি করে তার প্রয়োগও শুরু করেছে। আরও কয়েকটি দেশের টিকাও রয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে এর কোনোটি এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন বা টিকা সংগ্রহের বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মন্ত্রিসভাকে অবহিত করে। ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিশ্বে টিকা তৈরির অগ্রগতি এবং টিকা পেতে বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভ্যাকসিনের জন্য বিভিন্ন দেশ উঠেপড়ে লেগেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে ৪৬টি ভ্যাকসিনের, আর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ৯১টি ভ্যাকসিনের।

যারা টিকা তৈরি করছে, শুরু থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমাদের একটা বেইজলাইন হলো ডব্লিউএইচও যেটাকে রিকগনাইজ না করবে, সেটাকে আমরা অ্যাকসেপ্ট করব না। এটাকে বেজলাইন ধরে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্টগুলো এবং আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি পারসোনালি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এখানে প্রোডাকশনের জন্য।’

স্বাস্থ্য বিভাগের পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, গত ৪ জুন যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে লন্ডনে ‘গ্লোাবাল ভ্যাকসিন সামিট-২০২০’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সামিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও বার্তা প্রেরণ করেন, বিশেষ করে গ্যাভির (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন) পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার যোগ্য দেশ হিসেবে ঘোষণার যে আবেদন জানানো হয়, তা গ্রহণ করা হয়েছে।’

চীনের বেসরকারি কোম্পানি সিনোভ্যাকের টিকার বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের কাছে আইসিডিডিআর,বি আবেদন জানানোর পর তা অনুমোদন করা হয়েছে। এখানে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে।’

বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হলে টিকা কম দামে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটু লেস প্রাইসে আমরা ভ্যাকসিন পাব। শুধু তা-ই নয়, আমাদের এখানকার এক বা একাধিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ইন্ট্রোডিউস করবে।’

রাশিয়া টিকা প্রয়োগ শুরু করলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে। রাশিয়ার টিকার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘রাশিয়ার ক্যামেলিয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের এপিডেমিওলজি ও মাইক্রোবায়োলজি ‘স্পুটনিক’ ভ্যাকসিন প্রযুক্তি বাংলাদেশে হস্তান্তরের জন্য অফার দিয়েছে। এটাও বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। কিন্তু আমরা কন্ডিশন দিয়েছি এটার জন্য ডব্লিউএইচওর অ্যাপ্রুভাল লাগবে।’

ভারতের টিকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটি হচ্ছে ভারতের বায়োটেক, সেটা তারা আমাদের এখানে ট্রায়াল করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ ভ্যাকসিন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ৩৬ জনের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করেছে। অনলাইনে ওরিয়েন্টেশন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।’

ফ্রান্স ও বেলজিয়ামভিত্তিক সানোফি অ্যান্ড জিএসকে উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের দুটি ওষুধ কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। কভিড-১৯ টিকা কেনার জন্য বাজেটে একটি প্রকল্পের আওতায় ৬০০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থ সচিব আমাদের নিশ্চিত করেছেন, কোনো কারণে যদি ফরেন কারেন্সি না-ও পাওয়া যায়, আমাদের বাজেটে সেটার সংস্থান রাখা হয়েছে।’

বাংলাদেশ বিনা পয়সায় টিকা পাওয়ার সুযোগ নষ্ট করছে বলে যে কথা উঠেছে, তা নিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন আসার ইমিডিয়েট কোনো সম্ভাবনা নেই, এটা আমাদের বুঝতে হবে। সারা পৃথিবীতে একটা কম্পিটিশন চলছে। বিনা পয়সায় এই ভ্যাকসিন পাওয়ার এখনই কোনো সুযোগ নেই। যদি আসে গ্যাভির মাধ্যমে সেটাও একটু দেরি হবে।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘টিকা কখন কবে, বাজারে আসবে, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কোম্পানি বলতে পারছে না। আমি যে তালিকাটা দেখলাম, ২০২১ সালের এপ্রিল-মে-জুনের আগে মার্কেটে আসবে বলে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। যদি এর আগে সাকসেসফুল হয়ে যায়, তবে ইনশা আল্লাহ সবার সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ আছে।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘কিছু কিছু টেকনিক্যাল সাইডও আমাদের দেখতে হচ্ছে। দু-একটা ভ্যাকসিন আছে যেটা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এটা খুব ডিফিকাল্ট আমাদের মতো দেশে।’

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্যাকসিনের প্রাইসটা তো এখনো ফিক্সড হয়নি। সবকিছু দেখা যাক। তবে সাধারণ মানুষ যারা কিনতে পারবে না, সে জন্য ডেফিনেটলি একটা বড় পোরশন ফ্রি দেওয়া হবে। এটা প্রাইমারি চিন্তাভাবনায় আছে।’

সিনোভ্যাক বিনিয়োগের কথা বলছে, সরকার বিনিয়োগ না করায় একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে খবর ছড়িয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘অনিশ্চয়তা কিছুই নেই। তারা বলেছে কিছু একটা ফান্ডিং করার জন্য। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি। তারা যে ফান্ডিং চাচ্ছে, সেটা র‌্যাশনাল কি না, এটা সরকারি পর্যায়ে করতে হবে, নাকি বেসরকারি কোনো জায়গা থেকে করতে হবে, এগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।’

গতকালের বৈঠকে ‘রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়ণ : বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করে পরিকল্পনা বিভাগ।

নিবন্ধন ছাড়া লবণ আমদানি করলে জেল-জরিমানা : নিবন্ধন ছাড়া লবণ আমদানি ও লবণের ব্যবসা করলে জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন, ২০২০’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, জাতীয় লবণ কমিটি হবে ১৪ জনের। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাতীয় লবণ কমিটির সভাপতি হবেন। সদস্য সচিব হবেন বিসিক চেয়ারম্যান। এই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে আয়োডিনযুক্ত লবণ পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন সেল থাকবে। তারা এটা মনিটর করবে। জাতীয় মানমাত্রা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ থেকে ৫০ পিপিএম এবং খুচরা পর্যায়ে ২০ থেকে ৫০ পিপিএম মাত্রার আয়োডিন থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো ধরনের লবণ আমদানি, লবণ উৎপাদন ও গুদামজাত ভোক্তাপর্যায়ে পাইকারি সরবরাহ প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন বা আয়োডিনযুক্ত কারখানা স্থাপন বা অন্য কোনো লবণ কারখানা স্থাপন ও পরিচালনা করতে চাইলে তাকে এই আইনের অধীনে নিবন্ধিত হতে হবে। নিবন্ধন ছাড়া কেউ লবণ আমদানি, গুদামজাত, ভোক্তাপর্যায়ে পাইকারি সরবরাহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিশোধন বা আয়োডিনযুক্ত কারখানা পরিচালনা করে বা এর গুণগত মান নিশ্চিত না হয়, তাহলে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হবে বা অর্থদণ্ডের বিষয়টি খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, খসড়া আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। আইনটি মোবাইল কোর্ট আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।

সাতই মার্চকে ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ দেওয়া ভাষণের দিনটিকে ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে দিবসটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপনসংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারিকৃত পরিপত্রের ‘ক’ ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ দিন কোনো সরকারি ছুটি থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

এর আগে ঐতিহাসিক সাতই মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে গেজেট জারির নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের নির্দেশনা ও জাতীয় জাগরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া ভাষণে। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সাতই মার্চের ভাষণ এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূল প্রেরণা। এই ভাষণকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার চূড়ান্ত মঞ্চ গড়ে ওঠে। সাতই মার্চ ভাষণের নির্দেশনার আলোকে এ দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর আন্তর্জাতিক গুরুত্বও আছে। ইউনেসকো এই ভাষণটিকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেই বিবেচনায় জাতীয় জাগরণ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণার উৎস হিসেবে দিবসটি উদযাপন করার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।’

তিনি আরও বলেন, এই প্রস্তাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আছে। দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে দেশের জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ লালন-পালন ও যথাযথ চর্চা করা সম্ভব হবে। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা এ দিবসটি তাদের নিজস্ব কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন ও বাস্তবায়ন করবে।

বঙ্গবন্ধুকে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহ দিতেন বঙ্গমাতা : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আত্মজীবনী লেখার জন্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ব্রেইল সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন তিনি যেন তার (বঙ্গবন্ধু) জীবনীটা লিখে রাখেন। সেই থেকে তিনি কিন্তু লিখতে শুরু করেন। বাবা যতবার কারাগার থেকে মুক্তি পেতেন আমার মা জেলগেটে থেকে বাবার লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন।’

বঙ্গবন্ধুর সেই সব লেখার খাতা ১৯৭১ সালে প্রায় হারাতে বসেছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু সেই সময় আমরা সেটা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। যদিও আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুটপাট করে। সেখানে সবকিছু লুটপাট করলেও এগুলো যেহেতু একটা লাইনটানা রুলখাতা, এগুলো ওদের নজরে পড়েনি। ওদের কাছে এগুলোর কোনো মূল্য ছিল না। একসময় সেটা আমি উদ্ধার করে নিয়ে আসি। সেটার বিস্তারিত আমি “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটাতে লিখেছি।’

শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার আজীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যার ঘটনাও এ অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বইটির ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী যে ডায়েরি, সেটা ব্রেইলে প্রকাশ করা হয়েছে যাতে আমাদের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও পড়তে পারে এবং তার সম্পর্কে জানতে পারে। আমি মনে করি এটা একটা মহৎ উদ্যোগ।’

২০১২ সালের জুনে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ইংরেজি, উর্দু, জাপানি, চীনা, আরবি, ফরাসি, হিন্দি, তুর্কি, নেপালি, স্প্যানিশ, অসমীয়া ও রুশ ভাষায় বইটির অনূদিত হয়েছে।

মোড়ক উন্মোচনকালে তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পরে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। এই বই প্রকাশ হওয়ার পর সেই ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে কিছুটা হলেও আমরা রক্ষা পেয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকের আগে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মোড়ক উন্মোচন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ দুটি বইয়ের নামকরণই জাতির পিতার ছোট কন্যা শেখ রেহানা করেছেন।

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এবং মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তথ্য এখানে পাওয়া যায়। সারা বিশে^ বইটি ইতিমধ্যে ১৪টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য আমাদের কাছে অনুমতি চেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী তার প্রয়াত বান্ধবী সাংবাদিক বেবী মওদুদকে নিয়ে জাতির পিতার ডায়েরিগুলো সংগ্রহ এবং একে পরিপূর্ণ বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন উল্লেখ করে বলেন, ‘ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে বই প্রকাশ করেছি। যার ছয় খন্ড ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং ৭ম ও ৮ম খন্ড (মোট ১৪ খন্ডের মধ্যে) প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মাধ্যমেও কিন্তু আমাদের দেশের সংগ্রামের ইতিহাস, বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাসটা বের হয়ে এসেছে এবং আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এসব ব্যক্তিগত ডায়েরি যা পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো প্রতিটি খাতার ওপরই জেলখানার সেন্সরশিপের সিল ও সই রয়েছে। সময়গুলোও সেখান থেকে খোঁজ করে বের করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পরও খুনিরা ধানমণ্ডির বাসায় লুটপাট চালিয়েছিল। ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে তিনি যখন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরলেন, তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাকে ওই বাসায় প্রবেশ করতে দেয়নি। সেদিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে খুনিদের বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। আমি দেশে ফিরে আসার পর ওই বাড়িতে আমার ঢোকা নিষেধ ছিল, ঢুকতে পারিনি। সিলগালা দেওয়া ছিল।’

হঠাৎ করে ওই বছরের ১২ জুন তাদের কাছে মনে হলো বাসাটা খুলে দেবে। তখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে জাতির পিতার লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লেখাগুলো সেদিন পাওয়া যায়নি। তবে টাইপ করা পোকায় কাটা কতগুলো কাগজ সেদিন পাওয়ার কথা জানান শেখ হাসিনা।

দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর এক ভাগ্নে অতি পুরনো-জীর্ণপ্রায় এবং প্রায় অস্পষ্ট লেখার চারটি খাতা শেখ হাসিনাকে এনে দেন। তিনি ওই খাতা চারটি বঙ্গবন্ধুর আরেক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সংগ্রহ করেন। ওই লেখাগুলোই ছিল বঙ্গবন্ধুর হারিয়ে যাওয়া আত্মজীবনীর অংশ।

ধারণা করা হয়, শেখ মণিকে টাইপ করার জন্য খাতাগুলো দেওয়া হয়েছিল। পরে সেগুলো বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার দেওয়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায় গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয় ২০১২ সালের জুনে। সেই সঙ্গে বইটি ইংরেজিতেও প্রকাশ করা হয়, যার ভাষান্তর করেন ড. ফকরুল আলম।

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top