![]() |
ধানুয়া কামালপুর স্মৃতিসৌধ |
- ধানুয়া কামালপুর ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান ঘার্টি ছিল
- এ সেক্টরে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম জেলা নিয়ন্ত্রণ হতো
- সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের একটি পা হারান
- গণকবর গুলো আজ কালের স্বাক্ষী
- তাহের স্মৃতি স্তম্ভ
- ধানুয়া কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
- মির্ধাপাড়া মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি
- ধানুয়া কামালপুরকে মুক্তিযুদ্ধ নগরী ঘোষনার দাবি
- বীরমুক্তিযোদ্ধাদের হাতের ছাপে বাংলাদেশের মানচিত্র
- স্মৃতি সৌধটি সংস্কারের দাবি
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কয়টি সেক্টর ছিল তার মধ্যে ১১ নম্বর সেক্টরটি ছিল বিশেষ গুরত্বপূর্ণ। সারাদেশের অন্যান্য সেক্টরের চেয়ে ১১ নম্বর সেক্টরে সব চেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান ঘার্টি ছিল। ধানুয়া কামালপুর থেকে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম জেলা নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
ধানুয়া কামালপুরের পাশে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ ছিল মুুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুরো এলাকা’জুড়ে ছড়িয়ে পড়তেন সশস্ত্র সংগ্রামে। বিশাল এলাকা’জুড়ে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টরে’র আগে এই অঞ্চল যুদ্ধ পরিচালনা করতেন জেড ফোর্স। ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পান মেজর আবু তাহের (কর্নেল তাহের) । মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বেই ৮ বার পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
ভারতে’র মেঘালয় রাজ্যে’র তুরা জেলার মহেন্দ্রগঞ্জ ও জামাল’পুর জেলা’র পাহাড় ঘেঁষা বকশীগঞ্জ উপজেলা’র ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছি’ল। এখান থেকেই হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালায়। উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যে কোন মূল্যে এই ঘাঁটি দখল করা।
১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই সম্মুখ যুদ্ধে পাক বাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম শাহাদাত বরণ করেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হওয়ার’ পর মুক্তিযোদ্ধা’রা সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরে’র (পরে কর্নেল) পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা’রা হানাদার বাহিনীর ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করেন।
অবরোধের প্রথম দিনই কামালপুর মির্ধা পাড়া মোড়ে সম্মুখ যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের (পরে কর্নেল) এক’টি পা হারান। পরে ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডারে’র দায়িত্ব নেন উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীরপ্রতীক। এই যুদ্ধে আহত হন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (সাবেকমন্ত্রী মেজর হাফিজ) বীর বিক্রম।
পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদে’র বিনাশ করতে একের পর এক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। তারা পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযোদ্ধাদে’র না পেয়ে তাদের পরিবার’কে আক্রমণ করেন। তারা বিভিন্ন গ্রামে নিরীহ মানুষের উপর অমানুষি’ক নির্যাতন চালায় এবং গণহত্যা চালায়।
তৎকালীন বাট্টাজোড় ইউনিয়নে’র পশ্চিম দত্তেরচর গ্রামের মুক্তিকামী মানুষের উপর বর্বর নির্যাতন চালায় পাক সেনারা। ওই গ্রামের বেশ কয়েক’জন তরুন কিশোর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পাক সেনারা ক্ষুব্দ হয়ে নির্বিচারে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে একযোগে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেন এবং নিহত ১৭ জনকে একটি কবরে’ মাটি চাপা দেন।
বকশীগঞ্জ শহরে’র পুরাতন গোহাটি এলাকায় মোখলেছ চেয়ারম্যান’কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। বকশীগঞ্জ এন এম উচ্চ বিদ্যালয় ‘র পেছনেও গণহত্যা চালায় পাক বাহিনীর সদস্য’রা।
ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) , মুক্তিযোদ্ধা গাজী আহাদুজ্জামান, তসলিম উদ্দিন সহ শহীদ হন ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ জন সৈন্য মারা যায় এ যুদ্ধে ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদে’র মধ্যে ২৯ জনকে তাদের বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়।
এই সেক্টরের অধীনে বকশীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গণকবর বধ্যভূমি পড়ে থাকলেও এখনো অযতেœ , অবহেলা’য় রয়েছে সে গুলো। গণকবর গুলো কালের স্বাক্ষী হিসেবে পড়ে রয়েছেন এখনো।
ইতোমধ্যে ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে’র ধানুয়া গ্রামের ৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনা’য় গণকবর গুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে।
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণে তৎকালীন বিডিআরে’র (বর্তমানে বিজিবি) নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়। এই স্মৃতি সৌধটি ১১ নম্বর সেক্টরের মহান মুক্তিযুদ্ধে’র ধারক-বাহক হিসেবে মাথা উচু করে দাড়িয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে’র স্মৃতি বহন করছে ধানুয়া কামালপুর’ স্মৃতি সৌধ।
এখানে ’মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণে নির্মাণ করা হয়েছে ধানুয়া কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরে’র স্মৃতি রক্ষার্থে ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে তাহের স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
বকশীগঞ্জ এনএম উচ্চ বিদ্যালয়ে’র পেছনে’র গণকবরটি ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আজ অবধি বকশীগঞ্জ’ সরকারি উলফাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাক সেনাদের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃতুবরণ করা মানুষের গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয় নি। অযতœ অবহেলায় সেটি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বাট্টাজোড় পশ্চিম দত্তের’ চর গ্রামের গণকবরটি এখেনও সংরক্ষণ করা হয় নি।
স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবদুল মুন্নাফ জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে’র সময় আমার জেঠাতো ভাই মুজা আলী সহ ১৭ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হলেও এই গণকবরটি এখানো সংরক্ষণে’র উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। তাই তিনি দ্রæততম সময়ের মধ্যে গণকবরটি সংক্ষণ করার দাবি জানান।
তৎকালীণ স্বনামধন্য চেয়ারম্যান মোখলেছ কে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায়’ গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাকে বকশীগঞ্জ শহরের পুরাতন গোহাটি ব্রিজের পাশে একটি জঙ্গলে তার কবর দেয়া হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষকে কারণে অকারণে হত্যা করে এই জায়গায় পুতে রাখা হতো। স্বাধীনতার’ ৫০ বছর হলেও আজো মোখলেছ চেয়ারম্যানের কবর বা গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয় নি।
এরকম অসংখ্য জায়গায় মুক্তিযুদ্ধে’র স্মৃতি থাকলেও তা এখনো ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মুুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) শহীদ হলেও তার কবর কোথায় তা আজো সংরক্ষণ করা যায় নি। তার স্মৃতি চিহ্ন ধরে রাখতে তার নামে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ স্মৃতি সংসদ গঠন করা হলেও অযতœ অবেহলায়, রক্ষণাবেক্ষণে’র অভাবে সেটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
![]() |
বীরমুক্তিযোদ্ধাদের হাতের ছাপে বাংলাদেশ নামে একটি মানচিত্র আঁকা হয়েছে |
বগারচর ইউনিয়নের আলীরপাড়া গ্রামের গাজী আহাদুজ্জামান’কে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় প্রকাশ্যে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করে হত্যা করা হয়। আরেক মুক্তিযোদ্ধা তছলিম মিয়াকেও গুলি করে হত্যা করা হয়’। এই দুজনের কবরও আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায় নি। স্থানীয় প্রশাসন বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন নি।
মুক্তিযোদ্ধাদে’র স্মৃতি গুলো ধরে রাখতে ধানুয়া কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদে’র দাবি বিশেষ দিন ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গুলোর কোন মুল্য থাকে না। মহান স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস, ৪ ডিসেম্বর ধানুয়া কামালপুর মুক্ত দিবস ছাড়া বাকি দিন গুলোতে খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। ধানুয়া কামালপুর স্মৃতি সৌধটিও পড়ে আছে অবহেলায়।
২০০০ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই স্মৃতি সৌধটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু এই স্মৃতিসৌধে পাথর দ্বারা খোদাই করা মুক্তিযোদ্ধাদে’র নামের তালিকা রঙ না করার কারণে মুছে গেছে। ফলে কার কি নাম তা এখন বুঝা যায় না। বীরমুক্তিযোদ্ধা’রা এক স্মৃতি সৌধটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
বকশীগঞ্জ উপজেলার যেসব গণকবর বা মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি বিজরিত স্থান গুলো এখনো সংরক্ষণ করা হয় নি। সেগুলো দ্রæততম সময়ের মধ্যে সংস্কার বা সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান বীরমুক্তিযোদ্ধা বৃন্দ।
১১ নম্বর সেক্টরের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সহকারী অধ্যাপক আফসার আলী জানান, ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধের গুরত্ব থাকলেও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে’র চেতনা বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন চর্চা নেই। তারমতে এই এলাকাকে মুক্তিযুদ্ধের নগরী বলা যেতে পারে। এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উর্বর ভূমি। কিন্তু সদিচ্ছা’র কারণে আজ পর্যন্ত বকশীগঞ্জ পৌর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে উঠেনি।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থান ধানুয়া কামালপুরে’র মির্ধাপাড়া মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি জানান। একই সঙ্গে তিনি ৪ ডিসেম্বর ধানুয়া কামালপুর মুক্ত দিবস প্রতি বছরই সরকারিভাবে পালনের দাবি জানান।
বকশীগঞ্জ উপজেলা’র সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মফিজ উদ্দিন জানান, যেসব গণকবর এখনো সংরক্ষণ করা হয় নি। সেগুলো অবিলম্বে সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। পাশাপাশি ধানুয়া কামালপুর’কে মুক্তিযুদ্ধ নগরী ঘোষনার দাবি করছি।
বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনমুন জাহান লিজা বলেন, বেশিরভাগই গণকবর ও স্মৃতি বিজরিত স্থান গুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে সকল কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে’র চেতনা বৃদ্ধি করতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদে’র হাতের ছাপে বাংলাদেশ নামে একটি মানচিত্র আঁকা হয়েছে। একই সাথে বিভিন্ন ইউনিয়নে সড়ক গুলো বীরমুক্তিযোদ্ধাদে’র নামে নামকরণ করার জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
সম্পাদক
সেবা হট নিউজ
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।