পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী মার্কিন সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টোফ |
সেবা ডেস্ক: দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী মার্কিন সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টোফ।
গতকাল বুধবার (১০ মার্চ) মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা একটি কলামে তিনি একথা বলেছেন।
ক্রিস্টোফ লিখেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটিতে আশ্চর্যজনক মাত্রায় শিশু দারিদ্র্য রয়েছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের বড় নৈতিক অবনতি।
তিনি মন্তব্য করেছেন, বুধবার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর দেশটি এই দাগ মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা পদক্ষেপগুলো স্থায়ী করা হলে শিশু দারিদ্র অর্ধেকে নেমে আসবে বলে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
এরপর মার্কিন সাংবাদিক বাংলাদেশের ওপর আলোকপাত করে লিখেছেন, যে ফলাফল আসতে পারে তা বুঝতে আমাদের বিশ্বের অন্যপ্রান্তের শিক্ষা দেখতে হবে।
৫০ বছর আগে এই মাসেই গণহত্যা, দারিদ্র্য আর অনাহারের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জার তখন দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ ছবিগুলো বিশ্বে বাংলাদেশের একটি হতাশাজনক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৯১ সালের এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। আমি তখন নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্ভাগা দেশ’।
তখনকার প্রেক্ষাপটে আমি ঠিকই লিখেছিলাম। এধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও বাংলাদেশকে তখন অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছিল।
কিন্তু গত তিন দশকে আমার সব অনুমান ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমান মহামারির আগে চার বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতি বছর সাত থেকে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা চীনের চেয়েও দ্রুততর।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। এটা যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির ১০টি কাউন্টিসহ আরও কিছু জায়গার চেয়ে বেশি।
ক্রিস্টোফ লিখেছেন, একসময় হতাশার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের উন্নয়নের মডেল হতে পারে।
কলামে শিক্ষা ও মেয়েদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা তুলে ধরেছেন নিকোলাস ক্রিস্টোফ। তিনি লিখেছেন, আশির দশকে বাংলাদেশে ৩৩ শতাংশের কম শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারত। বিশেষত, মেয়েরা খুবই কম শিক্ষিত এবং অর্থনীতিতে তাদের অবদান ছিল একেবারে কম।
কিন্তু সরকার ও নাগরিক সংস্থাগুলো ধারাবাহিকভাবে নারীসহ শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করেছে। এখন বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে।
আগে নারী-পুরুষের বৈষম্য বিশাল থাকলেও এখন বাংলাদেশের উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।
ক্ষুদ্রঋণের অগ্রদূত নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উদ্ধৃতি তুলে ধরে ক্রিস্টোফ বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা হচ্ছে, নারীর অবস্থান পরিবর্তন, যা শুরু হয়েছে দরিদ্র নারীদের জীবনমানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।
তিনি লিখেছেন, ইউনুস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন যা নারীদের উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করেছে এবং তাদের জীবনসহ দেশের অবস্থা পাল্টে দিতে ভূমিকা রেখেছে।
পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিককের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ নারীদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করেছে।
এই শিক্ষিত নারীরাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প নারীদের কর্মসংস্থানের বড় জায়গা হয়ে উঠেছে।
যে শার্টটি আপনি এখন পরে আছেন, হতে পারে সেটা বাংলাদেশের কোনো নারীর বানানো। বাংলাদেশ এখন চীনের পরে বিশ্বের বৃহত্তম তৈরি পোশাক শিল্প রফতানিকারক দেশ।
বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে নিম্ন মজুরি, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, আগুনের ঝুঁকি ও অন্যান্য নিরাপত্তা সমস্যার কথা উল্লেখ করলেও ক্রিস্টোফ লিখেছেন, তবে শ্রমিকরা নিজেরাই বলছে, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করে ভাত রান্নার কাজ করার চেয়ে এ ধরনের চাকরি অনেক ভালো।
শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ শ্রমিকদের সুরক্ষায় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আরো লিখেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীরা এখন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কাজ করছেন।
এই নারীরাই শিশুদের টিকাদানে ভূমিকা রেখেছেন। মানুষকে টয়লেট ব্যবহারে সচেতন করে তুলেছেন। গ্রামের মানুষকে পড়তে শিখিয়েছেন।
তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন। বাল্যবিবাহকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
মানবসম্পদে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ সমাজে যে গতিধারা সৃষ্টি করেছে, তা সবার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
ক্রিস্টোফ লিখেছেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ‘দারিদ্র্য বিমোচনের অনুপ্রেরণার আখ্যান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ১৫ বছরে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন।
এছাড়া তিনি আরো বলেছেন, ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অপুষ্ঠিজনিত শিশুর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। যা এখন ভারতের চেয়েও কম।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা আধিক্যের বিষয়টিও উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, বাংলাদেশের নারীদের এখন প্রত্যেকের মাত্র দুটি সন্তান রয়েছে (আগে যা ছিল সাত)।
পুরস্কারজয়ী সাংবাদিকের মন্তব্য, সংক্ষেপে বাংলাদেশ বিনিয়োগ করেছে তার সবচেয়ে অবহেলিত সম্পদে, সবচেয়ে প্রান্তিক এবং কম উৎপাদনশীল অংশকে কেন্দ্র করে।
এ কারণে বাংলাদেশের মুনাফাও হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
ক্রিস্টোফের মন্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রও এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। তিনি লিখেছেন, কোটিপতিদের কাছ থেকে আমরা কোনও উৎপাদনশীলতা আদায় করতে যাচ্ছি না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে না পারা প্রতি সাত শিশুর মধ্যে একজনকে সহযোগিতা করলে দেশ হিসেবে আমরা অনেক বেশি উপকৃত হব।
শিশু-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কার্যক্রম সম্ভবত এটা করতে সক্ষম। আর ফেরতযোগ্য শিশু-কর-ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা উচিত।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দেখে আমরা বুঝতে পারি, প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা নিছক তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের ব্যাপার নয়, দেশ ও জাতির উন্নতির জন্যই এটা দরকার।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।