এই নদী তুমি : সোহানা রহমান

S M Ashraful Azom
0
এই নদী তুমি : সোহানা রহমান
খুব ছোটবেলায় একবার আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে গ্রামে গিয়েছিলাম আমরা। নিজেদের গ্রামে না। কাছাকাছি একটা গ্রামে। খাবারদাবার সাথে নিয়ে পিকনিকের মতো। সে গ্রামের পাশে একটা নদী ছিল। যদিও সবাই বলছিল ওটা একটা খাল। কিন্তু আমার কাছে ওটা নদীই ছিল। ছোটছোট মাটির ঘর, পাশ দিয়ে একটা নদী৷ ঠিক যেন ছবি আঁকার খাতায় আঁকা একটা গ্রামের দৃশ্য। আমার মনের ভিতর দৃশ্যটা চিরস্থায়ী হয়ে গেল।

নদীর (বা খালের) পাড়ের বাড়িগুলো বেশ উঁচুতে। বাড়ির সামনে ঢালু হয়ে তারপর নদী। একটা বাড়ির উঠানে উঁচু একটা ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে আমার এক দুলাভাই গান গাচ্ছিলেন, 'আমার হীরামন পাখি, ও আমার হীরামন পাখি'! আমি তখন বেশ ছোট, স্কুলেও যাই না৷ কিন্তু সেই গান আর গানের সুর এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি।

কি যে উথালপাতাল বাতাস ছিল সেদিন। অথবা হয়তো নদীর পাশে এমন বাতাস সবসময়ই থাকে। রোদে শরীর চিড়বিড় করে ওঠে, আবার পরক্ষণেই শীতল বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। সেদিন বিকেলের দিকে ঘুরে ফিরে আমরা বাসায় ফিরে এলাম৷ কিন্তু আমার সাথে সাথে চলে এলো নদীটা। কিছুদিন পরপরই আমার নদী দেখতে ইচ্ছা হয়। দৌড়ে ছাদে চলে যাই আমি, যাতে করে পানি ছুঁয়ে আসা বাতাস এসে স্পর্শ করে আমাকে। কিন্তু শহরের ভিতর নদী কই যে তাকে বাতাস ছোঁবে? নদী আর আমার দেখা হয় না।

আরেকটু বড় হওয়ার পর একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন শোনা শুরু করলাম, 'বড় হয়ে কি হবে তুমি?' বন্ধু বান্ধবীরা সবাই বলে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমিও সেটাই বলি। কিন্তু আমার মনে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পংক্তি ঘোরাফেরা করে,

'মা, যদি হও রাজি
বড় হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি'।

আমার এই নদীটার গল্প করতাম আমি আমার বন্ধু বান্ধবীদের সাথেও। ওরা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতো না যে পানি আমাকে এত কেন টানে? আমার এক বন্ধুকে যখনই জিজ্ঞেস করতাম, 'বড় হয়ে কি হবি?' সে উত্তর দিতো, 'আমি তোর নদী হবো'।

মন খারাপ হলে কিংবা মন খুব ভালো হলে আমার মনটা সেই নদীর কাছে চলে যায়। এরমাঝে আমি বেশ কিছু নদী দেখেছি, কিন্তু ছোটবেলার নদীটার মত কোনটা না। পানি আমার অসম্ভব ভালো লাগে। কোন ছবিতে নদী বা ঝর্না দেখলে আমি বারবার দেখতেই থাকি। দৃশ্যটা মুখস্থ করে নেই। নিজে ভালো ছবি আঁকতে পারি না। তাই চোখ বন্ধ করে কল্পনা করি। আমার সেই বন্ধুটা খুব ভালো ছবি আঁকে। সে নিয়ম করে আমাকে পানির ছবি এঁকে দেয়।

আমাদের বাড়িটা খুব খোলামেলা। আলো বাতাস  ভর্তি। দক্ষিণের ঘরটায় বসলে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি পড়ার টেবিলে পাতিয়ে ওই রুমটায় পড়ালেখা করি। একেকবার বাতাস আসে আমার মনে হয় ওই তো, ওইদিকে একটা নদী আছে। সেই বাতাস। পানির ঘ্রাণ আমি আলাদা করে বুঝতে পারি। আকাশ দেখে বুঝি আজ বৃষ্টি হবে নাকি মেঘগুলো উড়ে চলে যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখলাম। কোন কিছু এত বিশাল এত সুন্দর এত বিস্ময়কর হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। আন্দামানের এই সমুদ্রের অসহ্য সৌন্দর্য দেখে আমার চোখে পানি আসলো। সমুদ্রের পাড়ে বা নদীর পাড়ে থাকার ইচ্ছা এমন প্রবল হলো যা বলার না। ইচ্ছে হলো ছুটি শেষে আর না ফিরি। এখানেই থেকে যাই। জেলে হয়ে বা প্যারাসেইলিং এর ইন্সট্রাক্টর হয়ে। কিন্তু ক্রমেই ছুটি শেষ হলো, আর আমারও ফেরা লাগলো। কিন্তু মনে পড়ে আছে সেই আন্দামান সী-তে। বাড়িতে অনেক কষ্টে অনুমতি আদায় করে একাই গিয়েছিলাম ঘুরতে। তাই প্রিয় কারও সাথে আনন্দ ঠিকমতো ভাগ না করতে পারায় মনের কোণে একটু আফসোস থেকে গেলো। 

এরপর অনেক অনেক দিন আমার আর সমুদ্র দেখা হয়নি। নদীও না। লেখাপড়া আর চাকরির মাঝে এত ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে নদী আর সমুদ্র থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। তাই মাঝে মাঝে ছোটবেলার সেই নদীটা বের করি স্মৃতি থেকে। কেন যেন আমার অধরাই থেকে গেল আজীবন নদীটা। 

একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ সেই বন্ধুটাও সাথে ছিল। মেঘ করে এসেছে আকাশের কোণে। পানির গন্ধ পাচ্ছি। মনটা ভালো, বেশ ভালো। বৃষ্টি শুরু হবে যেকোন সময়ে। 

চট করে এক ফোটা পানি পড়লো। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার বন্ধুটা আমার হাত ধরলো। আমি চমকে উঠলেও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণের ভিতর মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আমি ভিজে যাচ্ছি। এতদিনের নদীটা যেন দেখতে পাচ্ছি। এতদিন পর যেন ধরতে পারছি। এতদিনে নদীটা যেন আমার হলো।

সোহানা রহমান

লেখক
সোহানা রহমান 
২৬/০৫/২০২০   



শেয়ার করুন

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top