‘শনিবারের চিঠি’ কবি নজরুলকে নিয়েও তামাশা করত

S M Ashraful Azom
0
‘শনিবারের চিঠি’ কবি নজরুলকে নিয়েও তামাশা করত



: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কিংবা জাতীয় কবি নজরুল কেহই রক্ষা পাননি ‘শনিবারের চিঠি’র ব্যঙ্গ থেকে। শুধু তারা নন, ব্রিটিশ রাজশক্তির দমননীতি ও অত্যাচারের ব্যপকতা, বিবিধ কুসংস্কারের প্রসার, ধর্মের নামে উগ্রপন্থা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টির সমালোচনা থেকে শুরু করে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ ইত্যাদি পত্রিকার বহু নামজাদা লেখক, নব্য লেখক গোষ্ঠী এবং তাদের লেখালিখিই ছিল এই পত্রিকার টার্গেট।

ত্রিশ-চল্লিশ দশকের একটি আলোচিত পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠি’।  প্রধানত ঐ সময়কার সাহিত্যসমাজ- রাষ্ট্রের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বর্ষণের উদ্দেশ্যেই পত্রিকাটির সূচনা। ছাপা হতো বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গচিত্র—কার্টুন। আর এভাবেই ‘কাউন্টার লিটারেচার’-এর ভাষায় ব্যতিক্রমধর্মী সমালোচনামূলক সাময়িকী পত্রিকা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের মাইলফলক হয়ে আছে বহু-নিন্দিত এবং বহু-প্রশংসিত হয় সেই পত্রিকাটি।  

 

আজ কথা হোক সেই লেখাগুলো নিয়ে, যা বিদ্ধ করেছিল কাজী নজরুল ইসলামকে। 


১৩৩৩ সালের আষাঢ় থেকে ১৩৩৪ সালের কার্তিক পর্যন্ত ‘শনিবারের চিঠি’-র বিভিন্ন সংখ্যায় কাজী নজরুলের বিভিন্ন রচনা ব্যঙ্গ করে অনেকগুলো প্যারোডি ছাপা হয়েছিল। ভাদ্র সংখ্যায় নজরুলকে ‘বাংলার আধুনিক বরপুত্র নবযুগ ধুরন্ধর সাহিত্য সারথি’ আখ্যা দিয়ে তার ‘অনামিকা’ কবিতার একটি প্যারোডি ছাপা হয় ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ নামে। লেখার রচয়িতা ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’। মাসিক এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় মধুকর কাঞ্জিলাল রচিত, ‘তোমাদের প্রতি’ নামে যে কবিতাটি ছাপা হয় সেটিও নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকেই ব্যঙ্গ করে লেখা। 


লেখাটি ছিল এমন- 


ওগো বীর

ফেলে দিয়ে কাঁথা আর খাটিয়া তাকিয়া

ওঠো, জাগ, গা ঝাড়িয়া, চুল রগড়িয়া

তবু উচ্চ শির...


হে সাহিত্য শিরোরত্ন আনিয়াছ টানি

মগজের কোন কেন্দ্র হতে? বল বীর,

কোন ব্যাধি তোমারে করেছে আজ এমন অস্থির?


হে কবি ‘কেমিস্ট’

প্রেম রসায়নে পকস্ফ পণ্ডিত ‘প্রেমিস্ট’

তব্য কাব্য ‘রি-এজেন্ট’ রসে

সর্ব প্রেম মূর্ত হয় সর্ব হুরী আসে তব বশে...


পত্রিকাটির এসব ব্যঙ্গ রচনার উদ্দেশ্য ছিল নজরুলের চরিত্র হনন, প্রমীলাদেবীকে বিয়ের পর থেকে যার শুরু। শুধু কবিতায় নয়, ১৩৩৪-এর ভাদ্র থেকে পৌষ, পাঁচটি সংখ্যায় ‘গণবাণী’ পত্রিকাকে ব্যঙ্গ করে ‘কচি ও কাঁচা’ নামে একটি পঞ্চাঙ্ক নাটক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। নাটকে উল্লিখিত পাত্র-পাত্রিগণ ছিলেন সম্পাদক, কার্ল মার্কস, শেলি, লেনিন, ট্রটস্কি, হুইটম্যান, প্রলেতারিয়েত বায়রন, বৌদি, খেঁদি, ছেঁড়া নেকড়া, ভাঙা চুড়ি, ছেঁড়া চুল ইত্যাদি। 


চরিত্রগুলোর প্রকৃত পরিচয়, কার্ল মার্কস (মুজফ্ফর আহমেদ), ট্রটস্কি (সৌমেন ঠাকুর), প্রলেতারিয়েত বায়রন (নজরুল ইসলাম)। এ নাটকের সময় খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দী, স্থান কলকাতা মহানগরী। নাটকে ‘ঢেঁকীর গান’, ‘কুলোর গান’, ‘চায়ের গান’, অর্থাৎ নজরুলের ‘কৃষাণের গান’, ‘জেলেদের গান’-এর প্যারোডি সংযোজিত হয়েছিল ‘যুগ লক্ষ্মণগুলো’ প্রকাশ পাবে বলে। নাটকটির সূচনা ‘ঢেঁকী ও কুলোর গান’ দিয়ে। পত্রিকাটির আশ্বিন সংখ্যায় নাটকটির দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের পরিচয়লিপিটি ছিল ‘গণবাণী’ অফিসের ব্যঙ্গচিত্র। বলা হয়- 


‘হ্যারিসন রোডের ওপরে একটি গৃহের দ্বিতলে সাপ্তাহিক বোলশেভিকী কার্যালয়। গেরুয়া খদ্দর পরিহিত সৌম্যদর্শন সুশ্রী একটি ছোকরা সেই চাদরের উপর বসিয়া নিবিষ্ট চিত্তে প্রুফ দেখিতেছেন, তাহার আকৃতি ও সাজসজ্জার সহিত এই ঘরের কিছুই ভাল খাপ খায় না, ইনি ট্রটস্কি (সৌমেন ঠাকুর)। পশ্চাতের অন্ধকার দরজা দিয়া ‘আর পারি না সাধুতে লো সই’ এই গাহিতে গাহিতে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ঘাড়ে গর্দানে এক হৃষ্টপুষ্ট কৃষ্ণকায় যুবকের প্রবেশ, ইনি প্রলেতারিয়েত বাইরন (নজরুল)। ইহার পিছনে কার্ল মার্কস (মুজফ্ফর আহমদ) লেনিন প্রভৃতি গণতন্ত্র দরদীদের প্রবেশ। বাইরন সজোরে ট্রটস্কির পিঠে এক থাবা মরিয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন হুররে থ্রি চিয়ার্স ফর ‘বোলশিভিক’...।


এই ব্যাপারে নজরুল সরাসরি শনিবারের চিঠির উদ্দ্যেশ্যে কিছু বলেছিলেন কিনা জানা যায়নি। তবে, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। শনিবারের চিঠিতে তাকে নিয়ে কম ব্যঙ্গ তো হয়নি! শনিবারের চিঠির ব্যঙ্গ-সাহিত্য সম্বন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে কিছু উচিত কথা লিখেছিলেন তিনি- “শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ করবার ক্ষমতা একটা অসামান্যতা অনুভব করেছি। বোঝা যায় যে এই ক্ষমতাটা আর্ট-এর পদবীতে গিয়ে পৌঁছেচে। আর্ট পদার্থের একটা গৌরব আছে--তার পরিপ্রেক্ষিতে খাটো করলে তাকে খর্বতার দ্বারা পীড়ন করা হয়। ব্যঙ্গসাহিত্যের যথার্থ রণক্ষেত্র সর্বজনীন মনুষ্যলোকে, কোনো একটা ছাতাওয়ালা-গলিতে নয়। পৃথিবীতে উন্মার্গযাত্রার বড়ো বড়ো ছাঁদ আছে, তার একটা না একটার মধ্যে প্রগতিরও গতি আছে, যে-ব্যঙ্গের বজ্র আকাশচারীর অস্ত্র তার লক্ষ্য এই রকম ছাঁদের পরে।...


ব্যঙ্গরসকে চিরসাহিত্যের কোঠায় প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে আর্টের দাবি আছে। শনিবারের চিঠির অনেক লেখকের কলম সাহিত্যের কলম, অসাধারণ তীক্ষ্ণ, সাহিত্যের অস্ত্রশালায় তার স্থান, --নবনব হাস্যরূপের সৃষ্টিতে তার নৈপুণ্য প্রকাশ পাবে, ব্যক্তিবিশেষের মুখ বন্ধ করা তার কাজ নয়।”


শেয়ার করুন

সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top