এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অসচেতনতায় বাড়ছে ঝুঁকি

Seba Hot News
0

সেবা ডেস্ক: ২০০৯ সাল থেকে দেশে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকার ফলে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য মানুষ বাধ্য হয়ে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে।

এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অসচেতনতায় বাড়ছে ঝুঁকি



বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এসব এলপি সিলিন্ডারের ৮৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে। কিন্তু ব্যবহার বিধি না মানায় এবং অসচেতনতায় বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, প্রতিটি এলপি সিলিন্ডার যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। এর সবশেষ উদাহরণ, গত বুধবার গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে সৃষ্ট আগুনের ঘটনা। এতে অন্তত ৩৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ৩২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্র জানায়, উপজেলার তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশে শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছে। কলোনির সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হলে পাশের একটি দোকান থেকে শফিকুল নিজেই গ্যাস সিলিন্ডার কিনে আনেন। ওই সিলিন্ডার লাগানোর সময় চাবি খুলে গ্যাস লিকেজ হতে থাকে। বিষয়টি দেখতে আশপাশের উৎসুক নারী-পুরুষ-শিশু জড়ো হয়। হঠাৎ পাশের চুলার আগুন থেকে ওই গ্যাসে আগুন লেগে উপস্থিত সবাই দগ্ধ হন।

বিস্ফোরক অধিদফতরসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সিলিন্ডারের মধ্যে এলপি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, মানসম্পন্ন সিলিন্ডারে তারচেয়ে চারগুণ বেশি চাপ সহ্য করার সক্ষমতা রয়েছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। নজিরও তেমন নেই। গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে আগুন ধরে যায়। এ জন্য সিলিন্ডারের সঙ্গে যে রেগুলেটর, হোস পাইপ, চুলাসহ অন্য জিনিস ব্যবহৃত হয়, সেগুলো মানসম্মত হতে হবে। এই অনুষঙ্গগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটাছে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে ‘রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন’ কঠোরভাবে মানার বিকল্প নেই।

গাজীপুরসহ দেশের অন্য স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সৃষ্ট আগুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলছে, ২০০৯ সালে দেশে এলপিজির চাহিদা ছিল ৬৫ হাজার টন। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ টন। ২০০৯ সালে এলপিজি ব্যবহারকারী ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার, বর্তমানে তা ৪০ লাখ। এসব এলপিজির ৮৪ শতাংশ রান্নার কাজে, ১২ শতাংশ শিল্পে এবং ৪ শতাংশ গাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে ৩ কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে চুলার (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটি) মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ১৭৫টি। বিস্ফোরণের (সিলিন্ডার ও বয়লার) ঘটনা ঘটেছে ১২৫টি। এ ছাড়া অজ্ঞাত কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭৯৬টি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতায় এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। এলপি সিলিন্ডার ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অনেকে তা না মানায় বারবার অগ্নিদুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। সিলিন্ডার ব্যবহারে এখনও সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এলপি সিলিন্ডার ব্যবহার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতেও তদারকি নেই।

গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সিলিন্ডার পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে দেশে এ নিয়ম মানা হয় না। অধিকাংশ সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। আবার পরীক্ষা করা হলেও তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। একটি সিলিন্ডারও পরীক্ষায় বাদ পড়ে না।

এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারে জ্বালানি বিভাগ, বিইআরসি ও বিস্ফোরক অধিদফতরের কিছু সতর্কতা ও নির্দেশনা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সিলিন্ডার কেনার সময় থার্মোসিল ও সেফটি ক্যাপ ঠিক আছে কি না তা দেখে কিনতে হবে। এলপিজি সিলিন্ডার সবসময় সমতল জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। রেগুলেটর না থাকলে সেফটি ক্যাপ লাগিয়ে রাখতে হবে। সিলিন্ডার থেকে অন্তত ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে চুলা। আর লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরত্বে স্থাপন করতে হবে সিলিন্ডার। ছায়াযুক্ত স্থানে যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে রাখতে হবে সিলিন্ডার। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে চুলা যেন চালু না থাকে। সিলিন্ডার স্থানান্তরের সময় টেনেহিঁচড়ে, ধাক্কা দেওয়া কিংবা মাটিতে গড়ানো যাবে না।

পাশাপাশি আরও যেসব বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার-সিলিন্ডারের আশপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রান্না শুরুর আধঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দেওয়া, রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ঘরের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেলে জানালা-দরজা খুলে দিতে হবে। এ সময় ম্যাচের কাঠি জ্বালানো, ইলেকট্রিক সুইচ, সিলিন্ডারের রেগুলেটর কিংবা মোবাইল ফোন অন বা অফ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বছরে অন্তত একবার গ্যাস সিলিন্ডার এবং এর সঙ্গে ব্যবহার করা অন্য সামগ্রী নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। কোনো যন্ত্রাংশ দুর্বল হলে তা দ্রুত বদলাতে হবে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় রান্নাঘরের মধ্যে গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিংগুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ অনুমোদিত বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা উচিত। সিলিন্ডারের গায়ের মেয়াদ নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। সিলিন্ডারের মেয়াদ সাধারণত ১০-১৫ বছর হয়। মেয়াদের তারিখ দেওয়া থাকে সিলিন্ডারের ওপরের দিকে। এ, বি, সি, ডি চারটি ইংরেজি বর্ণের সঙ্গে সাল দেওয়া থাকে। প্রতিটি বর্ণ আলাদা আলাদা মাসের নাম বোঝায়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সেই সঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, পাইপ রাবারের রিং, রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। আবার সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে, যদি এর পাইপ ও রেগুলেটর খারাপ মানের হয়। বাজারে ভালো-খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয়ে কম দামের মানহীন পণ্য কেনে। অনেকে আবার না জেনেই নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করছেন। এতেই ঘটছে বিপত্তি।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন) মেজর (অব.) একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন আছে। আমরা সেই নিয়মকানুন মানছি না। যেমন-গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের বিষয়গুলো দেখার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম বিস্ফোরক অধিদফতর। তারাই মূলত সিলিন্ডার তৈরি থেকে ব্যবহার উপযোগিতার অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক (অব.) ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘মানসম্মত সিলিন্ডার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে তদারকি বাড়াতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। তা হলেই দুর্ঘটনা কমবে।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও ভুলের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলেও তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, ‘সিলিন্ডারের মধ্যে এলপি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তারচেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি চাপ সহ্য করার সক্ষমতা রয়েছে মানসম্পন্ন সিলিন্ডারের। এ সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এটি ব্যবহারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। তবে মেয়াদের মধ্যে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো ঝুঁকি নেই। সিলিন্ডার দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাস লিকেজ থেকে ঘটে। হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভাল্ব ইত্যাদির দুর্বলতার কারণে যেকোনো সময় গ্যাস লিক হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস সামান্য আগুন কিংবা স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। আর যথাযথভাবে সিলিন্ডার পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহার না করা এবং মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।’

বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন বলেন, ‘এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। এ জন্য ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে। আমরা সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top