শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: আবদুল্লাহ আল-হারুন (জন্ম. ১০ই অক্টোবর ১৯৪৫) এক মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এ. এইচ. এম. এ. কুদ্দুস ও মাতার নাম ফাতেমা খাতুন।
![]() |
আবদুল্লাহ আল-হারুনের 'কালের মন্দিরা' : প্রবাসে বাংলাদেশিদের কঠোর জীবন-সংগ্রাম ও টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা এবং মৃত্যুবিষয়ক অন্যান্য রচনা |
আবদুল্লাহ আল-হারুনের পিতা আবুল হোফজাজ মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস তদানীন্তন জামালপুর মহকুমার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি কর্মজীবনে আশেক মাহমুদ কলেজ, জামালপুর, (অধ্যক্ষকাল ১৯৪৮-১৯৫৫), বগুড়া সরকারি কলেজ, বগুড়া (অধ্যক্ষকাল ১৯৬৭-১৯৭২)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। আবদুল্লাহ আল-হারুন ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। নাট্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র নটরাজ আবদুল্লাহ আল মামুন তার সহোদর অগ্রজ। আবদুল্লাহ আল-হারুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ.।
কর্মজীবনে তিনি পাবনার একটি কলেজে অধ্যাপনা, সরিষাবাড়ী কলেজে অধ্যক্ষসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এক অনিবার্য কারণে তিনি ১৯৭৭ সালে দেশ ত্যাগ করেন। প্রথমে গ্রিসে, এরপর ১৯৭৮ সালে জার্মানিতে বসবাস শুরু করেন। জীবনবোধের কঠিন বাস্তবতায় ছুটে বেড়িয়েছেন সমগ্র ইউরোপের নানা দেশে। তিনিই বাংলাদেশি লেখক হিসেবে বাংলা ভাষায় মৃত্যু ও মৃত্যুসঙ্গ নিয়ে গবেষণা ও গ্রন্থ রচনার পথিকৃৎ। এ বিষয়ে তার গভীর পাণ্ডিত্য প্রাচ্য-পাশ্চাত্যকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ইউরোপে মৃত্যুপথযাত্রীদের সঙ্গ দেওয়া হসপিস সংগঠনের অন্যতম কর্মী। এ সংগঠনের নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে তিনি শতাধিক মৃত্যুপথযাত্রীকে সঙ্গ দিয়েছেন। হসপিস সংগঠনের নবীন কর্মীদের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। মৃত্যুসঙ্গ ও মৃত্যু নিয়ে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা ভাষায় অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। তার এসব নিবন্ধ দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে' (২০০৯), 'অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন' (২০১০), 'মৃত্যু : একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা' (২০১১), 'মৃত্যুসঙ্গীর দিনলিপি' (২০১৭) অন্যতম।
তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ইংরেজি থেকে বাংলা এবং জার্মান থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন যা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এসব গ্রন্থের মধ্যে সুইডিশ উপন্যাস 'সিটি অব মাই ড্রিমস' (২০১০), নোবেল লরিয়েট হার্টা ম্যুলারের আউটেম শাউকেল 'হৃদস্পন্দন আশা হয়ে বাজে' (২০১১), টনি ব্লেয়ারের 'দ্য জার্নি' (২০১১) প্রভৃতি অন্যতম। আবদুল্লাহ আল-হারুনের এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
জার্মান প্রবাসী অভিমানী এই লেখকের আলোচ্য 'কালের মন্দিরা' (২০২৪) গ্রন্থের নাম দেখে কেউ হয়তো মনে করবেন এটি ইতিহাস, প্রবন্ধ কিংবা ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এ গ্রন্থটি হচ্ছে এসব কিছুকে সমন্বিত করে লেখক তার জীবনবোধ দর্শনের বাস্তবতাভিত্তিক এক অপূর্ব বর্ণনাধর্মী আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা। মহাকালের সময়ের আবর্তে আমরা একজন ব্যক্তি বা একটি প্রজন্ম যা স্বল্প সময়ের আবর্তে ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীতে এসে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাই। কালের প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান যেন একটি মুহূর্তের। আবদুল্লাহ আল-হারুনের ‘কালের মন্দিরা’ গ্রন্থে এই মুহূর্তটি বিস্তৃত অথচ স্বল্প পরিসরে তুলে ধরেছেন।
আরও পড়ুন:
আবদুল্লাহ আল-হারুনের ৪০৮ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে ২৬টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এগুলো হলো পটভূমি, স্মৃতিকথা কেন, যাত্রা হলো শুরু; পথের শেষ, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে; পশ্চিমে আজকে খুলিয়াছে দ্বার, মালা হতে খসে পড়া ফুলের একটি দল; তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই; জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, এ বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে; জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে নতুন চেতনা ও ভাবনা, আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো; মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হলো শেষ; মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে, মোদের কিছু নাইরে নাই, আমরা ঘরে বাইরে গাই; দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি, স্মৃতির পথ বেয়ে, হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, আলো আমার আলো ওগো, মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন; আমার যে আসে কাছে, কে যায় চলে দূরে; এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না, এক বাবলুর কথা, মারিয়ার শেষ নিঃশ্বাস, দীর্ঘ প্রবাসজীবনের আরো কিছু আপনজন, প্রাচ্য-প্রতীচ্য, শেষ কথা।
![]() |
বইয়ের নাম : কালের মন্দিরা লেখক : আবদুল্লাহ আল-হারুন সম্পাদনা : আসিফ হাসান নবী প্রচ্ছদ : সামছুল আলম, জার্মানি প্রকাশক : গল্পকার মূল্য : ৬০০ টাকা |
এ গ্রন্থের প্রতিটি পরিচ্ছেদের প্রাসঙ্গিকতার আলোকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ কিছু লাইন আছে যা বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের হৃদয়কে খুব স্পর্শ করে। ইউরোপে লেখকের বৈচিত্র্যময় জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বদেশের মানুষের প্রবাস জীবনের চালচিত্র ইত্যাদি বিবরণ এ গ্রন্থটির পরতে পরতে অনুভব করা যায়।
প্রবাসে দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ও এ গ্রন্থে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ফুটে উঠেছে যা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। মৃত্যুসঙ্গের নিষ্ঠুর ধারাবয়ান ও এ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার নির্মম বাস্তবতা পড়লে পাঠকমাত্রই শিহরিত হবেন। বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকজন লেখকের 'কালের মন্দিরা' নামে একাধিক সুখপাঠ্য বই আমাদের পড়া থাকলেও আবদুল্লাহ আল-হারুনের 'কালের মন্দিরা' অবশ্যই পড়া প্রয়োজন। এ বইয়ের প্রতিটি পরিচ্ছেদের লেখায় উঠে এসেছে লেখকের প্রজ্ঞা ও জীবনবোধ।
আবদুল্লাহ আল-হারুনের ‘কালের মন্দিরা' শুধু একটি বই নয়, এটি দেশ-বিদেশের নানান তথ্য, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির এক অন্তর্লীন বেদনার দলিল। বইয়ের নানা জায়গায় উঠে এসেছে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণের টানাপোড়েন, জাতিগত পরিচয় সংকট, আত্মীয়স্বজনহীন একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস যা শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং প্রবাসীদের এক সার্বিক চিত্র। সঙ্গত কারণেই গ্রন্থটির প্রচ্ছদের প্রথম ফ্ল্যাপে প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিসবিষয়ক লেখক ও সম্পাদক আসিফ হাসান নবী লিখেছেন : ”কালের মন্দিরা’ এমনি ধরনের একটি বই যা বার বার পড়তে করতে হবে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি লেখকের জার্মানিতে থিতু হওয়ার জীবনালেখ্য তারই ক্রমবিবর্তনের নির্মোহ চিত্র ফুটে উঠেছে প্রতিটি পরিচ্ছেদে। এই বইয়ের কাহিনিতে বিচিত্র সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। প্রতিটি চরিত্রই যেন একেকটি এপিক বা মহাকাব্য।"
আমরা মনে করি আসিফ হাসান নবীর উপর্যুক্ত কথায় কোনো অত্যুক্তি নেই।
আবদুল্লাহ আল-হারুনের এ গ্রন্থে গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে ইউরোপের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার ইতিহাস অন্তরঙ্গ বর্ণনায় উঠে এসেছে যা অনেক অজানা তথ্যও প্রথমবারের মতো জানতে পারবেন। এক বাক্যে বললে বলতে হয় আবদুল্লাহ আল-হারুনের 'কালের মন্দিরা' ইউরোপের সঙ্গে স্বদেশের তার সময়ের আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথামূলক অভিজ্ঞতার এক দুর্লভ দলিল। এই বইতে ইউরোপের মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্যের যে করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা সত্যিই বেদনাদায়ক। আমৃত্যু শিকড়-সঞ্চারী আত্মমগ্ন এই লেখক তার ‘কালের মন্দিরা’ উৎসর্গ করেছেন মাতৃসম ভ্রাতৃজায়া ফরিদা মামুনকে, রবীন্দ্রনাথের কয়েক স্তবক কবিতার মাধ্যমে।
এ কথা বারবার উচ্চারিত হয় যে, দুঃখের অনুভূতি যার তীক্ষ্ণ তার নাম কবি কিন্তু আবদুল্লাহ আল-হারুন কবি না হলেও কবিতার একজন নিবিষ্ট পাঠক ও সমঝদার। ইউরোপের অনেক শহরে প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজ মাতৃভূমি ও শৈশব-কৈশোরের বেড়ে ওঠা জামালপুর শহরের যে চিত্র তিনি এ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন তা অপূর্ব ও অনন্য। ইংরেজ কবি জোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বাণীকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন : "পূর্ব পূর্বই, পশ্চিম পশ্চিমই; দুটোর কখনো মিল হবে না। প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের এই সুস্পষ্ট পার্থক্য এখানে সর্বত্র দৃশ্যমান।... এখানে কোনো প্রেম নেই, পারস্পরিক বোঝাপড়া নেই।”
[উদ্ধৃতি : কালের মন্দিরা (দীর্ঘ প্রবাস জীবনের আরো কিছু আপনজন), পৃষ্ঠা ৩১০]
একজন আত্মসচেতন ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ লেখক হিসেবে আবদুল্লাহ আল-হারুনের 'কালের মন্দিরা' গ্রন্থে যখন যেসব কথা এসেছে সেসব প্রসঙ্গে তিনি শুধু কেবল নিজের অভিজ্ঞতাই বলেননি বরং এ-সম্পর্কিত যত তথ্য তার জানা সব বর্ণনা করেছেন। এ গ্রন্থে পাঠক শুধু আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথায় আটকে থাকবেন না, অনেক তথ্য পাবেন যেগুলো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশকে বুঝতে কারো না কারো কাজে লাগবেই।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।