বিশ্ব মন্দা অনিবার্য

S M Ashraful Azom
বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে পৌঁছে বিশ্ব পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা আজ এমন অবস্থায় এসে ঠেকেছে যেখানে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা তার নিত্যসঙ্গী। সঙ্কটের একটা দিক সামাল দিতে না দিতেই অন্যদিকে নতুন সঙ্কট হাজির হচ্ছে। ফলে সমস্যা-সঙ্কট থেকে ক্ষণকালের স্বস্তিও মিলছে না। বিকাশের পূর্ববর্তী স্তরে সঙ্কট মোকাবিলায় যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো পরবর্তী স্তরে সেইসব অস্ত্র অকেজো হয়ে পড়ছে। সঙ্কট সামাল দিতে তাই নতুন নতুন অস্ত্রের সন্ধান করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন অস্ত্রেও তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না।

২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের জেরে যে বিপর্যয় গ্রাস করেছিল বিশ্ব অর্থনীতিকে তার থেকে মুক্তি আজও সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে কিনা সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার যে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় বাস্তবে তা ভিত্তিহীন। অর্থনীতির মৌলিক ভিতটাকে ক্রমশ দুর্বল ও আলগা করে বৃদ্ধির সূচকগুলিকে ফাঁপানো হচ্ছে।

বিশ্ব অর্থনীতির এমন অন্তঃসারশূন্য বিকাশের অনিবার্য পরিণতি যে মন্দার প্রকোপ বৃদ্ধি এবং শেষ পর্যন্ত মহামন্দার আবাহন পর্ব সেই শিক্ষা ১৯২৯ সালের বিশ্ব মহামন্দা থেকেই পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন ইতিহাসের সেই দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে দুনিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছেন। অবশ্য তার এই সতর্কতাকে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালকরা ভাল চোখে নেননি। রাজনের এমন ব্যাখ্যা ও মন্তব্য ধুঁকতে ধুঁকতে চলা বিশ্ব অর্থনীতির সামনে হতাশার চাদর ঢেকে দিতে পারে এই আশঙ্কায় চাপা অসন্তোষ ছড়ায় সর্বত্র। ফলে চাপে পড়ে রাজনকে নতুন করে দিতে হয় তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা।

কিন্তু ব্যাখ্যা যা-ই দিন বিপর্যয়ের যে আশঙ্কার কথা তিনি বলেছেন সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। তেমনি তার পর্যবেক্ষণকেও উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কারণ ২০০৮ সালের সঙ্কটের পূর্বাভাস ক্ষীণ আকারে হলেও তিনি ২০০৫ সালে দিয়েছিলেন। বিশ্ব অর্থনীতি যে মোটেই সুস্থ ও সবল নয় পুঁজিবাদী অর্থনীতির যেকোনো মুরুব্বিই জানেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে কেউই আত্মগ্লানি বাড়াতে চান না। সকলেই চেষ্টা করেন সত্যকে চাপা দিয়ে একটা মিথ্যা বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে। পুঁজিবাদই বিকাশের একমাত্র পথ। মাঝে মধ্যে একটু-আধটু সমস্যা হলেও সেটা অচিরেই মিলিয়ে যায়। এই বিশ্বাস যদি সাধারণের মনে প্রতিষ্ঠিত করা না যায় এবং পুঁজিবাদ সম্পর্কে যদি বলিষ্ঠ আশাবাদ জাগিয়ে রাখা না যায় তাহলে পুঁজিবাদের অন্তঃসারশূন্য কঙ্কালসার দেহটা জনমানসে উন্মোচিত হয়ে যাবে। এই দায় রাজনের নেই তা নয়। তথাপি তিনি পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে অপ্রিয় সত্যকে সামনে এনেছেন পুঁজিবাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই।

পুঁজিবাদ তার অন্তর্নিহিত যে সঙ্কটকে আড়াল করে মার্কসবাদীরা তাকে উন্মোচিত করে জনতার দরবারে। আজ রাজন যা বলছেন অনেকদিন ধরেই বামপন্থীরা তা বলে আসছেন। পুঁজিবাদের বিকাশের বর্তমান স্তরে তার উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সীমাবদ্ধতা এসে যাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন সম্পদ সৃষ্টির সামর্থ্য হারাচ্ছে। ক্রমশ প্রকট হতে থাকা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে আর্থিক ব্যবস্থার দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। মুদ্রা ছাপিয়ে অর্থের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। তাতে সুদের হার কমতে কমতে শূন্যের কাছাকাছি নেমে যাচ্ছে। মুদ্রার ক্রমাগত প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়নের ফলে জিনিসের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে আয় না বাড়ায় কমছে চাহিদা। অর্থাৎ অর্থনীতির আর্থিকীকরণের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থনীতিকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ফাঁপা অর্থনীতি। আমেরিকা, ইউরোপ, জাপানের মতো উন্নত পুঁজিবাদে এখন চলছে নড়বড়ে বিকাশের প্রতিযোগিতা। কে কার ঘাড়ে ভর করে টিকে থাকবে তার প্রতিযোগিতা। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। পুঁজিবাদে এটাই অনিবার্য।
ট্যাগস

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top