মানুষের জীবন কি এতই মূল্যহীন যে, জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করিতে গিয়াও তাহাকে পদদলিত হইয়া মরিতে হইবে? ময়মনসিংহ শহরে গত শুক্রবার সকালে যে মর্মবিদারক ঘটনাটি ঘটিয়া গিয়াছে—তাহা এই প্রশ্নটিকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছে। একটি-দুইটি নহে, কমপক্ষে ২৫টি জীবন ঝরিয়া পড়িয়াছে চোখের পলকে—যে জীবনের সহিত জড়াইয়া আছে আরও বহু মানুষের জীবন-জীবিকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিহতদের অধিকাংশই নারী। অনুমান করা কঠিন নয় যে, তাহাদের অনেকেরই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান আছে, নির্ভরশীল বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা অসুস্থ স্বামী আছে। কেহবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ঈদ উপলক্ষে জাকাতের কাপড় বিতরণের সংবাদ পাইয়া একটি শাড়ি কিংবা লুঙ্গির আশায় ছুটিয়া গিয়াছিলেন, ফিরিয়াছেন লাশ হইয়া। এই মৃত্যুর দায় কে বহন করিবে সেই প্রশ্ন তো আছেই। তবে সর্বাপেক্ষা বড়ো প্রশ্নটি হইল, এই যে এতগুলি পরিবার অনিশ্চয়তার অথৈ সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইল—তাহাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কে লইবে? রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করিয়াছেন। জাকাতদাতাসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে গ্রেফতারও করিয়াছেন পুলিশ। কিন্তু কিছুতেই যে এই ক্ষতি পূরণ হইবে না তাহা সহজেই অনুমেয়।
ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করিয়া লইবার মহত্ উদ্দেশ্যকে সামনে রাখিয়া দরিদ্রদের মধ্যে জাকাতের কাপড় বিতরণের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের পাশাপাশি বহু প্রতিষ্ঠানও ইহাতে সম্পৃক্ত আছে এবং তাহাদের সংখ্যা দিনদিন বাড়িয়া চলিয়াছে। আর সেখানে যে, হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটিয়া থাকে তাহাও সুবিদিত। অব্যবস্থাপনার কারণে অতীতেও জাকাতের কাপড় দিতে গিয়া একাধিক মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও ঘটিয়াছে। অতএব, ইহা বলা যাইবে না যে অনভিজ্ঞতার কারণে এমনটি ঘটিয়াছে। জাকাতের কাপড় বিতরণের উদ্যোগটি যাহারা নিয়াছিলেন, তাহারা সম্ভাব্য দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন কিনা— সেই প্রশ্ন এড়াইয়া যাওয়া সম্ভব নহে। প্রয়োজনে তাহারা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে পারিতেন। পূর্বাহ্নে বিষয়টি তাহাদের অবহিত করা হইয়াছিল কিনা তাহাও স্পষ্ট নহে। অবহিত করা হউক বা না হউক, এই ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক সময় পুলিশ ও প্রশাসন স্বতঃপ্রণোদিতভাবেও প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি নিয়া থাকে। এই ক্ষেত্রে ইহার ব্যত্যয় ঘটিল কেন—তাহাও আমাদের বোধগম্য নহে।
অনভিপ্রেত হইলেও এই ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এই উপমহাদেশে মাঝে-মধ্যেই ঘটিয়া থাকে। অপ্রিয় হইলেও সত্য যে, ছবিটি যতটা না দারিদ্র্যের তাহার চাইতে অধিক হইল বিশৃঙ্খলার ও দায়িত্বহীনতার—যাহা এই অঞ্চলের অনেকটা মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যই বলা চলে। যেভাবেই দেখা হউক না কেন, বিষয়টি মোটেও গৌরবের নহে। আমরা আশা করি, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হইবে। তবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলির জন্য এই মুহূর্তে সব চাইতে বেশি প্রয়োজন বস্তুগত সহায়তা। তাহাদের ক্ষতি পূরণ হইবার নহে, তবু যতদূর সম্ভব নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহতদের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করিতে হইবে জরুরি ভিত্তিতে।
আমরা হতাহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।