মাহে রমজানের শুরু থেকেই আল্লাহর ঘর মসজিদ জমজমাট। আল্লাহর বান্দারা বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ মাসে সর্বাধিক মসজিদমুখী হন। আল্লাহর ঘর আল্লাহর বান্দা নিয়ে ভরপুর হয় পবিত্র রমজানের দিবা-রাত। অন্যান্য সময়ে ওয়াক্তিয়া নামাজে কোনো কোনো মসজিদে বেশিরভাগ কাতার ও ফ্লোর খালি থাকলেও রমজানে চেহারা বদলে যায় মসজিদের। প্রতি ওয়াক্তেই মসজিদ ভরে যায় কাতারবন্দিতে। মসজিদ যেন মা-বাবার মতোই বুকে ও বাহুডোরে আগলে ধরে ঈমানদারদের। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মায় ক্ষুদে শিশুরা আসমানী পরশে নেয়ে ওঠে। বিশেষত শুক্রবারের জুমা নামাজের চিত্র তো অবর্ণনীয়। জুমায় ছোট-বড় সব মসজিদ ঠাসা হয়ে যায় নামাজিদের আগমনে। এমনকি তার ছাদে, সিঁড়িতেও জায়গা ধরে না। অধিকন্তু মসজিদের প্রাঙ্গণ এবং অলিগলি, সড়ক-মহাসড়কও চলে যায় আল্লাহর ঘরের দখলে, আল্লাহওয়ালাদের পদতলে। মসজিদের এ ভরা যৌবন ও বেহেশতি আনন্দ দেখে কে? তবে এ ঘন বুকভরা আনন্দের মাঝেও মসজিদ গোপনে চোখ মোছে। তার বুকে একটা কনকনে ব্যথা ধরে। কেন না তার ঘরে দেখা নেই মুমেনাদের। মুমেনারা আসেন না বলে তার কত কষ্ট! আল্লাহর ঘর জানে মুমেনারাও মসজিদে আসেন না বলে সংসার ও সমাজ নষ্ট। সারা পৃথিবীতে মসজিদে আর গোরস্তানে মহিলা মুমেনারা যেতে পারেন না। আমাদের দেশে কেবল গুটিকত মসজিদ ছাড়া সব মসজিদে মুমেনাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আহা! একি নিষ্ঠুরতা। মসজিদ আল্লাহর আর বেহেশতের দরজা। সেখানে কিনা প্রবেশ নিষিদ্ধ মায়েদের, বোনদের ও মেয়েদের! আমাদের দেশেও কোনো কোনো মহল্লার মসজিদে কোনো কোনো ফ্লোর ছেড়ে দেয়া হয়েছে মহিলাদের জন্য কিংবা কোনো কোনো অংশ বরাদ্দ রয়েছে। রমজান মাস কোরআনের মাস, সিয়ামের মাস ও কিয়ামের মাস। আর এসব তো মসজিদেই জমজমাট বাস্তব চর্চায়। তাই মসজিদের দুঃখ সমাজ ও সংসার এবং দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার অধিকারী মহিলাদের জন্যও যেন সমাজের এবং মসজিদের মুরুব্বীরা চিন্তা করেন এবং অতিসত্বর ব্যবস্থা করেন। নতুবা যাদের পায়ের তলায় বেহেশত ঘুরপাক খায় তারা যদি আল্লাহর কাছে নারাজি জানান, তাহলে মুমেন পুরুষেরা কোন্ দরজা দিয়ে বেহেশতে যাবেন? তাই মুমেন পুরুষ এবং পুরুষ আলেম-ইমাম ও খতিবরা, মাতৃজাতির জন্য আল্লাহর ঘরে জায়গা করে দিন। ফালতু অজুহাত দেখানো থেকে হাত গুটিয়ে নিন। নতুবা আপনারা যখন মসজিদে ইবাদত-বন্দেগিতে বেহেশত লাভের আশায় ব্যস্ত থাকেন, তখন যদি মায়ের দল দোকান-পাট ও সুপার মার্কেটে জিয়ারত করতে চলে যান তার দায়-দায়িত্ব আপনাদের ঘাড়েই বর্তাবে। নবীজির সময়ে, খোলাফায়ে রাশেদার সময়ে যখন যুদ্ধ আর যুদ্ধ চলছিল তখন যদি নারীরাও মসজিদে জামাতে ও জুমায় শরিক হতে পারেন এবং নবীজি ও খলিফাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে ও শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করতে পারেন, তখন আজ মহিলাদের মসজিদ থেকে দূরে রাখার ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী খোঁড়া যুক্তি দেখাবেন না, আল্লাহর ঘর মসজিদকে কাঁদাবেন না। তাহলে সব আশা-ভরসা নস্যাৎও হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর বান্দা নর-নারী সবার জন্যই আল্লাহর ঘর খোলা রাখা চাই। মক্কা শরিফ, কাবা শরিফ, মদীনা শরিফ, মীনা, আরাফাত প্রভৃতির সঙ্গে মিল রেখে ও মিল হয়ে চলুন। আল্লাহর ঘর মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তা না বলার বানোয়াটি হাদিস বহাল থাকলেও পবিত্র রমজান মাসে দুনিয়াবী খানাপিনা নিয়ে তৈরি ইফতারিতে জমজমাট মুসল্লী সমাবেশ চলে ইফতারির সময়। ঢাকার দু-একটি মসজিদে হাজার হাজার লোকের ইফতারির আয়োজন হলেও বেশিরভাগ মসজিদে শত শত রোজাদার ভাই ইফতারির জিয়াফতে শরিক হন। জমে উঠে সেখানে বেহেশতি দস্তরখানা ও সওগাত। এমনকি আমার জানা মতে, দেশের অনেক মসজিদে সেহরির সময়ও রোজাদার কিয়ামুল্লাইলের শরিকানরা একত্রে সেহরি খান। বিশেষত ই’তেকাফের শেষ দশ দিনে সেহরির সময়েও চলে জান্নাতের পরশপূর্ণ খানাপিনা। রমজানের কোরআন নাজিলের এ পরিবেশে আল্লাহর ঘরের ভরা এ যৌবনে ইফতার ও সেহরির মাহফিল আরও জমজমাট হয়ে উঠুক! ঘর-সংসারের খাবার-দাবার নিয়ে নারীরা ও নরেরা ছুটে চলুক মসজিদে, গড়ে তুলুন তাওহিদের নূরানী ও রূহানী সমাজ। আউলিয়াকেরামের মতে, ঈমানদারদের বছর গণনা শুরু হয় রমজান মাস দিয়ে। আর রমজানের ফুল-ফসল হচ্ছে আল-কোরআন এবং তার চর্চার কেন্দ্র হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ। বহু দেশ ও সমাজে মুসলমান নর-নারীর পরিচয়-ঠিকানা হয়ে এসেছে মসজিদের নামে। আসলেও মসজিদই আমাদের পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড। আমরা কার্যত মসজিদকে তালাক দিয়ে দিয়েছি। ফলে আমরা ছিটকে পড়েছি মূল ধারা গতিপথ ও কেন্দ্র থেকে।
মসজিদের মিম্বর, মিহরাব, হল, বারান্দা ও প্রাঙ্গণ বেশিরভাগ সময়ই থাকে জনশূন্য ও অন্ধকারে। মসজিদের এ দুর্গতি-দুরাবস্থা প্রকৃত পক্ষে আমাদেরই মন, সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র। মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ তথা মসজিদ সমাজই রূহানী মানব সমাজ। মসজিদই ঈমানদার মুসলিম উম্মাহর মন-প্রাণ ও ধন-সম্পদ। মসজিদই মুসলমানদের মাদ্রাসা-মক্তব, স্কুল-কলেজ ও গণবিশ্ববিদ্যালয়। মসজিদেও মিহরাবই উম্মতের দুর্গ। নফসে আম্মারা এবং শয়তান ও তার জিন-ইনসান বাহিনীর হাত থেকে নিরাপদ থাকার শক্তিশালী আসমানী দুর্গ। এ ঐশী শক্তি চর্চা কেন্দ্র আজ হয়ে পড়েছে পরিত্যক্ত মৃতবৎ ঘরে। এখানে প্রাণহীন নামাজ হয় পাঁচ বেলায়, কিন্তু শরিয়ত, তরিকত, মারিফত ও হকিকতের ইলম ও আমল পরিত্যক্ত হয়েছে মসজিদ থেকে। মসজিদ থেকে আউলিয়া তৈরি হচ্ছে না, নায়েবে রাসূল তৈরি হচ্ছে না; আল্লামা গাউস, কুতুব, মুজাদ্দিদ, দার্শনিক হাকিম ও সমাজ নামাজেরও ইমাম তৈরি হচ্ছে না। এমনকি বড়ই আফসোস যে, রমজান মাসেও তারাবিহ নামাজের বদলে ‘তাড়াতাড়ি’ নামাজ পড়ানো হচ্ছে। কোরআন খতম হচ্ছে দ্রুততম গতিতে অর্থ, তাৎপর্য ও তাফসির হচ্ছে না। বারো রাকাত আর বিশ রাকাতেও তাড়াতাড়ি নামাজে আল্লাহর ঘর বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে কেরাতের ঐশী প্রেম আর আল্লাহর লাহুতি জগতের নেশা-আসক্তি জমছে না। মসজিদে গিয়ে অর্থশূন্য দুর্বোধ্য নামাজ চর্চা হচ্ছে, কিন্তু সমাজ থেকে দুর্নীতি-পাপাচার কমছে না। কারণ আমরা রূহের শক্তিতে জীবিত ও শক্তিশালী হচ্ছি না, মসজিদ নূরে ও রূহে জিন্দা হচ্ছে না। আমরা যদি ব্যক্তি, সমাজ, সংসার, দেশ ও বিশ্বকে ঈমান ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলিয়ান, সতেজ ও চৌকস দেখতে চাই তাহলে আমাদের মসজিদকে অবশ্যই নারী-পুরুষের সতেজ ঈমান, কোরআন ও রমজান দিয়ে ফের আবাদ করতে হবে। - See more at: http://www.jugantor.com/islam-and-life/2015/07/03/288164#sthash.3QhZ9OpR.dpuf