সরকার সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত
মুনাফার হার ২ শতাংশ কমিয়েছে। আগে যেখানে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে মুনাফা
দেয়া হত, বর্তমানে তা কমিয়ে ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ হার নির্ধারণ করে দেয়া
হয়েছে। মুনাফার এই হার আরও কমিয়ে দেয়ার দাবি করেছে কেউ কেউ। বিশেষ করে
ব্যাংক ব্যবসার এ্যাসোসিয়েশন এই মর্মে দাবি উঠাচ্ছে যে, সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত
মুনাফার হার আরো কমানো না হলে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের আমানতের সুদহার
কমানো সম্ভব হবে না। কারণ তখন সব আমানত চলে যাবে সঞ্চয়পত্রে, ব্যাংকে আর
কেউ আমানত রাখবে না। আর আমানতের সুদহার কমানো সম্ভব না হলে ঋণের সুদহারও
কমানো সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি
বিভিন্ন মহল- বিশেষ করে শিল্পপতি ব্যবসায়ী মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে যে,
ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে হবে। কারণ বর্তমানে ঋণের যে
সুদহার ব্যাংকগুলো নিচ্ছে, তা কোন ক্রমেই ব্যবসা বা শিল্পবান্ধব নয়। এই
হারে ঋণ নিয়ে কারও পক্ষে শিল্প ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলো
বলছে যে, বিশেষ করে মেয়াদি আমানতের সুদহার কমানো না গেলে গড় আমানতের সুদহার
কমবে না। ঋণের সুদহারও বিশেষভাবে কমানো সম্ভব হবে না। বর্তমানে সরকারি
ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর
ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। বিশেষ করে নতুন জেনারেশনের ব্যাংকগুলো এখনও
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হারে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আমানত সংগ্রহ করে চলেছে।
সেই সাথে খেলাপি ঋণের বোঝার কারণে ব্যাংকের গড় কস্ট অফ ফান্ড কমানো সম্ভব
হচ্ছে না। এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ৫ শতাশ স্প্রেড যোগ করলে কোন
ক্রমেই ঋণের সুদহার ১৩-১৪ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। আর এসএমই
ঋণের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও করুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এসএমই
খাতের জন্য স্প্রেড লিমিট তুলে দেয়া হয়েছে। অথচ এসএমই খাতের ঋণের ঝুঁকি সব
থেকে কম। এর প্রমাণ ব্যাংকগুলোকে এসএমই ঋণের বিপরীতে সবচেয়ে কম প্রভিশন
(দশমিক ২৫ শতাংশ) রাখতে হয়। এখন ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে ২০-২৫ শতাংশ হারে
সুদ নিচ্ছে। তবে কি সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের সুদহার নামিয়ে আনার ব্যবসায়ীদের যে
দাবি তা অধরা থেকে যাবে?
ব্যাংকের কস্ট অফ ফান্ড বেড়ে যাবার কারণ:
১।
ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ডিপোজিট সংগ্রহের নিম্নহার ১০ শতাংশ (-) যার পরিমাণ
২০-২৫ শতাংশ, আর উচ্চহার ১০ শতাংশ (+) এর পরিমাণ ৭৫-৮০ শতাংশ এখনও
বিদ্যমান।
২।
৬০টি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের বিপরীতে প্রদত্ত ফান্ডের ডিপোজিটের সুদহার
শূন্য না থাকা। ব্যাংকের কস্ট অফ ফান্ড বেড়ে যাবার এটাও একটা কারণ।
প্রকল্পের অর্থ এসটিডি একাউন্টে জমা রাখার কারণে ব্যাংকগুলোকে একদিকে যেমন
সুদ গুনতে হয় তেমনি, সময়মত প্রকল্পের কাজের বিল মেটাতে না পারার কারণে
প্রকল্প দীর্ঘায়িত হয়। ঠিকাদাররা সময়মত কাজ উঠাতে আগ্রহী হয় না।
৩। ঋণ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং ক্লাসিফিকেশনের কারণে কস্ট অফ ফান্ড বাড়ছে।
৪। সিন্ডিকেট লোন এর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বেশি সমস্যায় পড়ছে। এগুলোতে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি।
ঋণ
ব্যবস্থাপনার সাথে সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশের বিষয়টি খুব বেশি সাংঘর্ষিক নয়।
এর কারণ প্রথমত: সঞ্চয়পত্র হল একটি সরকারি বন্ড যা ঋণ গ্রহণের একটি
হাতিয়ার। সরকার বর্তমান সময়ে মূলত উন্নয়ন কাজের ব্যয় মেটাতে সঞ্চয়পত্র
বিক্রির মাধ্যমে ঋণ করে। সঞ্চয়পত্র যদি বিক্রি না হয় তবে বেশি করে ব্যাংক
থেকে ঋণ নিতে হবে। এর ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সংকট সৃষ্টি হবে। বেসরকারি
খাতের ঋণ প্রবাহ কমে যেতে পারে। তাই ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার ঋণের একটি অংশ
সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করাই সমীচীন। তবে এর পরিমাণ কত হবে তা
নীতি-নির্ধারকদেরকে হিসাব করে ঠিক করতে হবে। দেখা গেছে ২০১৪-১৫ সালে
সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা, যা
গত মে মাস নাগাদ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকায়। সরকার কেন অতি
উচ্চসুদে এই ঋণ সংগ্রহ করবে? এই ঋণের বোঝাতো সুদসহ দেশের সাধারণ মানুষের
উপরেই বর্তাবে। তাহলে সঞ্চয়পত্রের সুদের বিষয়ে সরকারের নীতিমালা কি হবে?
প্রথমত সরকারকে ঠিক করতে হবে কত টাকা তারা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংগ্রহ
করবে। দ্বিতীয়ত লক্ষ্যমাত্রার সেই অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতি কি হবে? আগে আসলে
আগে সুযোগ দেয়া হবে এই নীতি, না- প্রতিটি পরিবারের ষাট-ঊর্ধ্বব্যক্তির জন্য
একটি নির্দিষ্ট অংকের সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ দেয়া। এ কথা সত্য যে,
সঞ্চয়পত্রের সুদহার বর্তমানের থেকে কমানো মোটেই উচিত হবে না। এটা যেমন
জাতীয় সংসদে উত্থাপিত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর দাবি- তেমনি জনদাবিও। তবে
কেবল সরকারি বন্ড অর্থাত্ সঞ্চয়পত্রের বিষয়টি আলোচনায় কেন? বেসরকারি বন্ড
অর্থাত্ কর্পোরেট বন্ডের সুদ হারতো কম না। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আইবিবি
এল বন্ড বা ব্র্যাক ব্যাংকের বন্ড এর সুদের হারতো সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদের
হারের থেকেও বেশি। সেই বন্ড কিনতে জনসাধারণকে উত্সাহিত করা হচ্ছে না কেন?
শেয়ারবাজারে বিদ্যমান আস্থার সংকটের কারণে ইকুইটি শেয়ারে বিনিয়োগ হয়তো
ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডগুলো কি দোষ করেছে? এখানে বিনিয়োগতো
প্রায় ঝুঁকিমুক্ত। কৃত্রিমভাবে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগে সংকট সৃষ্টি
করে রাখা হলেও একটু চেষ্টা করলে আর একটু আন্তরিক হলে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব।
মিউচুয়াল ফান্ড, পেনসনফান্ড, ইউনিটফান্ড এগুলোই শেয়ারবাজারের
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। এগুলোতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারলে একদিকে যেমন
সঞ্চয়পত্রের উপর চাপ কমবে তেমনি, শেয়ারবাজারে বিদ্যমান তারল্য সংকটও
অনেকাংশে কমবে।
লেখক: সভাপতি, এসএমই ওনার্স