ভয়ঙ্কর ছবিতে কুৎসিত হবে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের মোড়ক, রেস্তোরাঁ-যানবাহন হবে শতভাগ ধূমপানমুক্ত, এমবিবিএস-বিডিএস শিক্ষার্থীরা হবেন অধূমপায়ী। এ লক্ষ্য নিয়ে ক্রমশ কঠোর উদ্যোগে তামাক বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসা হিসেব বলছে, দেশের আড়াই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান করেন। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ পুরুষ ও ২ শতাংশ নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছেলে ও ১ শতাংশ মেয়ে ধূমপানে আসক্ত। প্রতিবছর ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ ও ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তামাক ব্যবহারজনিত কারণে মারা যাচ্ছেন, যা নিম্ন আয়ের অন্যান্য দেশের গড় থেকে বেশি। এছাড়া স্ট্রোকসহ বিভিন্ন তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর মারা যান ৯২ হাজার মানুষ। এসব চিত্রে শঙ্কিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ‘তামাক ব্যবহারজনিত রোগে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন মানুষ, যা জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তাদের অনেকেই এমন একটি বয়সে মৃত্যুবরণ করছেন, যখন তার ওপর পরিবারের অনেক দায়িত্ব থাকে’- বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ‘তাই ক্রমশ কঠোরতায় বাধ্য হচ্ছে সরকার’- জানিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গবেষণাই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের তামাকবিরোধী পদক্ষেপের ফল বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। সেসব দেশে তামাকজাতীয় পণ্য, বিশেষ করে সিগারেটের প্যাকেটে কুৎসিত ছবি দেওয়া হচ্ছে আরও আগে থেকেই। কোথাও কোথাও আবার সিগারেটের মোড়কে রঙ এবং লোগো ব্যবহারেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও প্রয়োজনে তেমন উদ্যোগ এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না’- বলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো, সতর্ক করা এবং সর্বশেষ আইন প্রয়োগে তামাক নিয়ন্ত্রণ- সব চেষ্টাই করা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নজরদারি রাখছেন বলেও জানান তারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রায়ই তার বক্তব্যে সাবধান করে দিচ্ছেন, মনে করিয়ে দিচ্ছেন তামাক ও ধূমপানবিরোধী কঠোরতার কথা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধন হয় ২০১৩ সালেই। চলতি বছর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালাও প্রকাশিত হয়েছে। বিধি অনুসারে, আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের উভয় পাশে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী থাকবে। বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেটে সাতটি ভয়ঙ্কর ছবি থাকবে। ধূমপানের ভয়ঙ্কর পরিণতি তুলে ধরা হবে এসব ছবিতে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে তামাকজাত দ্রব্যে আরোপিত ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থও তামাক নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। এগিয়ে চলেছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও তামাক চাষ নীতিমালা তৈরির কাজ। চলতি বছর সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ ৬২টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান তামাক নিয়ন্ত্রণে বাজেট বরাদ্দ করেছে। জেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরসহ ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে গত নয় মাসে পরিচালিত হয়েছে প্রায় ৮০০ ভ্রাম্যমাণ আদালতও। দেখা গেছে, ধূমপায়ীরাই শুধু নন, অন্যের ধূমপানের খেসারত দেন সাধারণ মানুষেরাও। ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রসহ নানা জায়গায় ধূমপায়ী না হয়েও আশেপাশের ধূমপায়ীদের ছাড়া ধোঁয়ায় অনেককেই ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানিসহ নানাবিধ কষ্টদায়ক রোগে ভুগতে হচ্ছে। তাই সারাদেশে রেস্তোরাঁ ও যানবাহনগুলোকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করতে রেস্তোরা মালিক সমিতি ও যানবাহন মালিক সমিতিগুলো সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। তাদেরকে টার্গেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কাজে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এরই মধ্যে কয়েক দফা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বছর থেকে এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তিচ্ছুরা ‘অধূমপায়ী’ হিসেবে সার্টিফিকেট জমা দিতে বাধ্য থাকবেন। ধূমপায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেও ভর্তির সুযোগ পাবেন না। এভাবে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ধূমপানমুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার-কর্তাব্যক্তি এবং পরিবারের কর্তা-কর্ত্রীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম।