সেবা ডেস্ক: মা দিবস হল মায়ের সন্মানের প্রতি অনুগত্য প্রকাশের জন্য বছরের একটি বিশেষ দিন। যুগ যুগ ধরে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই উদযাপিত হয়ে আসছে এ দিবস। এই দিনটি মূলত বিশ্বের অনেক দেশে বিভিন্ন দিনে আলাদা ভাবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। সারাবিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসেই বিশ্ব মা দিবস পালন করা হয়।
কিছু কিছু ইতিহাসবিদের মতে, মা নিয়ে এই দিনটি প্রাচীন গ্রিসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে সূত্রপাত হয়। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেলের উদ্দেশে পালন করা হত একটি উৎসব।
মহাবিষ্ণুবের সময়েও এমন একটি উৎসব পালন করা হত বলে ধারণা করা যায়। প্রাচীন রোমানদের ‘ম্যাত্রোনালিয়া’ নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরও একটি বিশেষ দিনের কথা জানা যায়। সেই দিনটিতে সবাই সবার মাকে বিভিন্ন ধরনের উপহার দিত।
ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে পালিত মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকায় উল্লেখ করা রয়েছে। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী এটিকে বলা হয় লেতারে সানডে, যা কিনা লালেন্টের সময়ে চতুর্থ রোববার পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার সম্মানে।
এককথায় বলা যায়, খ্রিস্টানদের ক্যাথলিক ধর্মে এই দিনটি বিশেষভাবে ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার পূজায় সমর্পিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে সনাতন ধর্মে এই দিনটিকে ‘মাতা তীর্থ আনুসি’ বা ‘এক পক্ষকালব্যাপী মাতৃ তীর্থযাত্রা’ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস মাদারস ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) গঠন করেন। এমনকি তিনিই ‘মে মাসের দ্বিতীয় রোববার’ আর ‘মা দিবস’ এই দুটি শব্দের বহুল প্রচারণা চালাতে সক্ষম হন।
বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো ছুটির দিনকেই বিশ্বের অন্যান্য দেশ খুব সহজেই গ্রহণ করে। আর সে কারণেই হয়ত যুক্তরাজ্যে পালিত মাদারিং সানডে বা গ্রিসের মন্দিরে যিশুর প্রাচীনপন্থী পূজা-অর্চণার মতো মাতৃত্বের সম্মানে অনুষ্ঠিত দিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তারিখটিকে নির্ধারণ করা হয়।
ক্যাথলিক দেশগুলোতে ভার্জিন মেরি ডে বা ইসলামিক দেশগুলোতে পয়গম্বর মুহম্মদ (স.)-এর মেয়ের জন্মদিনের মতোই বিশ্বের কিছু কিছু দেশ তাদের প্রধান ধর্ম অনুযায়ী মা দিবসের তারিখটি পরিবর্তন করে নিয়েছে।
ইতিহাস আরও সাক্ষ্য দেয়, মূলত মা দিবসটি কিছু প্রাচীন উৎসবের সামান্য প্রামাণিক সাক্ষ্যস্বরূপ। যেমন, সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উৎসব, যা কিনা গ্রিকের সিবেল ধর্মীয় রীতি থেকে এসেছে। অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টানদের মাদারিং সানডে উদযাপনের কথাও স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিভিন্ন দেশে ‘মা দিবস’ সূচনার ইতিহাসঃ
আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মধ্যে মায়েদের সম্মানে বিভিন্ন ধরনের উৎসব রয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তবুও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশগুলোতে ব্রিটিশ প্রথানুযায়ী মা দিবস পালন করে থাকে।
প্রতিবছর ২৭ মে বলিভিয়ায় মা দিবস পালন করা হয়।
কোচাবাম্বা শহরে ১৮১২ সালের ২৭ মে সংঘটিত করনিলার যুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বহু নারীকে স্পেনের সৈন্যবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। যুদ্ধের নির্মম স্মৃতিস্মারক হিসেবে ১৯২৭ সালের ৮ নভেম্বর এই দিনটিকেই সরকারিভাবে মা দিবস হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
মা দিবসটি চীনদেশে আগে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চীনাদের মনেও এই দিনটি ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে। এখন খুব জাঁকজমকভাবেই সেখানে মা দিবস পালিত হয়।
চীনের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত ফুল কার্নেশন মা দিবসের একটি জনপ্রিয় উপহার। দরিদ্র মায়েদের সাহায্য করা, এমনকি পশ্চিম চীনের গ্রামাঞ্চলের হতদরিদ্র মায়েদের কথা মানুষকে মনে করানোর জন্যই ১৯৯৭ সালে মা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় চীনে।
গ্রিসে যিশুকে মন্দিরে পেশ করার ইস্টার্ন অর্থডক্স ফিস্ট ডের সঙ্গেই মা দিবস পালন করা হয়। থিওটকস (ঈশ্বরের মাতা) যিনি যিশুকে জেরুজালেমের মন্দিরে এনেছিলেন। সে কারণেই এই দিনটিকে গ্রিসে মা দিবস হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে।
নবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এর মেয়ে ফাতিমার জন্মবার্ষিকীর দিন ইরানে মা দিবস পালন করা হয়।
ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে, রানি কজুনের (রাজা আকিহিতোর মা) জন্মদিনটিকেই মা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে জাপানে। জাপানে এই দিনটি খুব জনপ্রিয় একটি দিন। মা দিবস উপলক্ষে চীনের মতোই জাপানেও মায়েদের কার্নেশন আর গোলাপ ফুল উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ১৯২২ সালে আলভারো ওব্রেগন সরকার মা দিবসের প্রচলন করেন। সেই বছরই এক্সেলসিয়র নামক সংবাদপত্রটি এই দিনটির সমর্থনে এক ব্যাপক প্রচার চালায়। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময়ে লাজারো কার্দেনাস সরকার মা দিবসকে একটি ‘দেশাত্মবোধক উৎসব’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কার্দেনাস সরকার এই দিনটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। যেমন, জাতীয় উন্নয়নে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিকে মনে করিয়ে দেওয়া, মেক্সিকানদের মায়ের প্রতি আনুগত্যকে আরও সুদৃঢ় করা। এমনকি মেক্সিকান মহিলাদের উপর থেকে চার্চ ও ক্যাথলিকদের প্রভাব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এমন একটি দিবসের প্রচলন করা হয় সে সময়।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মানুয়েল আভিলা কামাচোর স্ত্রী সলেদাদ ওরজকো গার্সিয়া ১৯৪০ সালে মা দিবসের প্রচার শুরু করেন। এটিকে একটি সরকারি উৎসবে পরিণত করেন।
১৯৪২ সালে উদযাপিত মা দিবসটি সপ্তাহব্যাপী উৎসবে পরিণত হয়। সেই উৎসব উপলক্ষে ঘোষণা করা হয় যে, প্রত্যেক মহিলা, যারা সেলাই মেশিন বন্ধক রেখেছে– তারা বিনামূল্যে সেগুলো ফেরত পাবে মন্ট দ্য পিয়েদাদ থেকে।
১৯৪২ সালেই মা দিবসের বিশাল অনুষ্ঠান পালনের একই সময়ে লেওন শহরে পাদ্রিরা ভার্জিন মেরির ২১০তম উৎসব পালন করে। সে উপলক্ষে একটি বড় কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। এর ফলে বর্তমানে মেক্সিকোতে উল্লিখিত মা দিবসটি বিশ্ব মা ও ভার্জিন মেরি, এই দুজনরই উৎসব বা দিন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
⇘সংবাদদাতা: সেবা ডেস্ক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।