হারাম শরীফে ও ইহরাম অবস্থায় যে কাজ করবেন না

S M Ashraful Azom
0
হারাম শরীফে ও ইহরাম অবস্থায় যে কাজ করবেন না
সেবা ডেস্ক: হজ যাদের সামর্থ আছে তাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। হজ হচ্ছে ওই বিধান যার সঙ্গে সাধারণ মুসলমানের পরিচয় কম। এর বিপরীত হচ্ছে নামাজ, রোজা ও জাকাতের বিধান। এগুলোর সঙ্গে সকলের কমবেশি পরিচয় আছে। এই পার্থ্যকের কারণও রয়েছে।

নামাজ, রোজা সকলের ওপর ফরজ। বিধায় তা পালন করতে গিয়ে সকলেই এ সম্পর্কে কিছু না কিছু জেনে নেয়। এ দিক থেকে জাকাতের বিধান একটু পিছিয়ে। জাকাত আদায়কারীর সংখ্যা কম। তাই জাকাতের বিধান ভালোভাবে জানে এমন লোকের সংখ্যাও কম। তবে জাকাতের শাখাগত মাসয়ালা কম হওয়াতে আদায়কারীকে তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।

সেই তুলনায় হজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ এর শাখাগত মাসয়ালা বেশি, মানুষের জানাশুনা কম আর অধিকাংশ বিষয় হলো প্রাক্টিকেললি। অর্থাৎ হজের প্রায় সকল বিধানই সরাসরি আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হয়। তাই আমরা দেখতে পাই সহীহ শুদ্ধভাবে হজ আদায়ের জন্য প্রতিটি হজ কাফেলার সঙ্গে একজন করে মোয়াল্লিম বা প্রশিক্ষক থাকে; যিনি হাজিদেরকে হজের বিভিন্ন বিধান আদায়ের ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়ে দেন। তারপরও মানুষ ভুল করে। নামাজের ভুল হলে সাহু সিজদা দিয়ে তা পুষিয়ে নেয়া যায়। হজেও ভুল হলে তা পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে যার দ্বারা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হয় তাকে বলা হয় দম।

সামনে আমরা হজের দম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এর আগে হজের প্রকার ও কোন প্রকার হজ আদায় করা উত্তম সে বিষয়ের দিকে যাচ্ছি।


হজের প্রকার: 

বিধানগত দিক থেকে হজ তিন প্রকার-

(এক) শুধু হজ আদায়ের নিয়তে সফর করা। শরয়ী পরিভাষায় এই হজকে ‘ইফরাদ হজ’ বলা হয়।

(দুই) এক ইহরাম দ্বারা হজ ও ওমরা আদায়ের নিয়ত করা এবং ওমরা আদায়ের পর ইহরাম না খুলে বরং জিলহজ মাসের দশ তারিখ কোরবানি দিয়ে ইহরাম খোলা। শরয়ী পরিভাষায় এই হজকে ‘কিরান হজ’ বলা হয়।

(তিন) হজের মাসে ওমরার অধিকাংশ তওয়াফ আদায় করা। ওমরার কার্যক্রম শেষ করে, সঙ্গে হাদি বা কোরবানির পশু না আনা হলে মাথা মুন্ডিয়ে হালাল হয়ে যাওয়া এবং মক্কায় অবস্থান করতে থাকা। তারপর হজের দিনগুলোতে নতুনভাবে হজের ইহরাম বেধে হজ আদায় করা। আর যদি সঙ্গে কোরবানির পশু নিয়ে আসা হয় তাহলে ওমরার ইহরাম খোলা যাবে না বরং ওই ইহরাম থাকাবস্থায় হজের ইহরাম বেধে হজ আদায় করা। শরয়ী পরিভাষায় এ রকম হজকে বলা হয় ‘তামাত্তু হজ’। এই হজের জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে হাজি সাহেবকে মিকাতের বাইরের অধিবাসী হওয়া। যারা মক্কা মোর্কারমা বা মিকাতের ভেতর বসবাস করে তাদের জন্য হজে তামাত্তু জায়েজ নেই।

কোন প্রকারের হজ উত্তম:

পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেছে হজ তিন প্রকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন প্রকারের হজ উত্তম। এ ব্যাপারে ফকিহগণের মাঝে ব্যাপক ইখতেলাফ পরিলক্ষিত হয়। এবং প্রত্যেকে স্বপক্ষে কোরআন, সুন্নাহ দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো। মনে রাখতে হবে যে, তিন প্রকারের হজ জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কারো মাঝে কোনো ইখতিলাফ নেই। সকলেই বলেন, তিন প্রকার হজ কোনোরূপ মাকরূহ হওয়া ছাড়াই জায়েজ। রাসূল (সা.) এর সঙ্গে হজ আদায়কারী সাহাবায়ে কেরাম তিন প্রকারের হজই আদায় করেছিলেন। ইখতেলাফ হচ্ছে সর্বোত্তম হজ কোন প্রকারেরটি তা নিয়ে। ইমামগণের মত-

(এক) ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর মতে সর্বোত্তম হজ হচ্ছে ‘কিরান’ তারপর ‘তামাত্তু’ এরপরের পর্যায়ের উত্তম হলো ‘ইফরাদ হজ’। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর দলিল হচ্ছে হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস, যেখানে বলা হয়েছে তিনি হজরত নবী করিম (সা.)-কে ওমরা ও হজের তালবিয়া এক সঙ্গে পড়তে শুনেছেন। (সুনানে তিরমিজী-৮২১)।

(দুই) ইমাম মালেক ও শাফি (রাহ.) এর মতে সর্বোত্তম হওয়ার দিক থেকে প্রথম হচ্ছে ‘ইফরাদ’ তারপর ‘তামাত্তু’ এর পরে রয়েছে ‘কিরান’ এর স্থান। তাদের দলিল হলো হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস, তিনি বলেন, হুজুর (সা.) ইফরাদ হজ আদায় করেছিলেন। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকেও এ ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ইফরাদ হজ করেছিলেন। হজরত আবু বকর, ওমর ও উসমান (রা.)ও ইফরাদ হজ আদায় করেছিলেন। (সুনানে তিরমিজী-৮১৮)।

(তিন) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহ.) বলেন, কোরবানির পশু সঙ্গে নিয়ে তামাত্তু হজ করা হলো সর্বোত্তম। হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী উত্তম হওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ‘ইফরাদ’। আর সর্বশেষ হলো ‘কিরান’। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের দলিল হচ্ছে হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর হাদিস। হাদিসের ভাষ্য হচ্ছে, একবার হজরত সাদ ও দাহ্হাক ইবনে কায়েস (রা.) তামাত্তু হজের আলোচনা তুললেন। হজরত দাহ্হাক ইবনে কায়স বলেন, তামাত্তু হজ কেবল জাহেল লোকদের দ্বারাই সম্ভব। হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এ কথা শুনে বলেন, তুমি এ কী কথা বললে ভাতিজা! তখন দাহ্হাক বলেন, আমি হজরত ওমর (রা.)-কে দেখেছি, তামাত্তু হজ থেকে লোকদেরকে নিষেধ করতে। এর উত্তরে হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, স্বয়ং নবী করিম (সা.) এ হজ আদায় করেছেন আর আমরা তার সঙ্গে তা আদায় করেছি। (সুনানে তিরমিজী-৮২২)।

লক্ষণীয় বিষয় যে, তিন ইমামের তিন মত এবং প্রত্যেক মতের সমর্থনে হাদিস রয়েছে। এখান থেকে যে বিষয়টি উপলব্ধি করা দরকার, তা হচ্ছে ইমামগণের ইখতেলাফ মনগড়া কোনো বিষয় ছিল না। বরং তাদের ইখতেলাফের পেছনে হাদিসগুলো পরস্পর বিরোধ হওয়ার বিষেশ ভূমিকা রয়েছে। যারা এ বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহী তারা শায়েখ আওয়ামা হাফিজাহুল্লাহুর ‘আছারুল হাদিছিশ শরীফ ফী ইখতেলাফিল ফুকাহা’ এবং শাইখুল হাদিস জাকারিয়া (রাহ.) এর ‘আসবাবু ইখতিলাফিল ফুকাহা’ অধ্যয়ন করতে পারেন। তাহলে মনে প্রশান্তি আসবে। যারা বিভিন্ন দ্বিধাদ্বন্দে ভোগেন তাদের এ অবস্থার নিরসন হবে ইনশাআল্লাহ। উত্তম হজের ব্যাপারে হানাফি মাজহাবের মতের পক্ষের প্রায় সত্তর জন সাহাবির মত পাওয়া যায়। তাছাড়া অন্যগুলোর ব্যাপারে যে হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা পরস্পর বিরোধ হওয়ায় হানাফি মাজহাবের মতটিই উত্তম।

হজে নিষিদ্ধ কাজ সমূহের বর্ণনা:

‘জিনায়াত’ আরবি ভাষার একটি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ত্রুটি করা বা ভুল করা। হজের আলোচনায় যখন এই শব্দ আসে তখন এর উদ্দেশ্য হয় প্রত্যেক ওই কাজ যা ইহরাম অবস্থায় হওয়া বা হারাম শরীফে থাকার কারণে নিষিদ্ধ। তাহলে নিষিদ্ধ কাজের দুটি ভাগ বের হলো- (এক) ওই সকল কাজ যা ইহরাম অবস্থায় থাকার কারণে নিষিদ্ধ। (দুই) ওই সকল কাজ যা হারাম শরীফে থাকার কারণে নিষিদ্ধ।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ সমূহের বর্ণনা:

(এক) সুগন্ধি ব্যবহার করা: সুগন্ধি দ্বারা প্রত্যেক ওই বস্তু উদ্দেশ্য, যা থেকে সুগন্ধ আসতে থাকে এবং মানুষ এটাকে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন মেশকে আম্বর, কাফুর, জাফরান ইত্যাদি।

(দুই) পুরুষের জন্য ইহরাম অবস্থায় সেলাইকৃত কাপড় পরা।

(তিন) পুরুষের জন্য ইহরাম অবস্থায় মাথা ও মুখ উভয়টি এবং মহিলার জন্য শুধু মুখ ঢাকা নিষেধ।

(চার) শরীরের পশম ওঠানো।

(পাঁচ) হাত পায়ের নখ কাটা।

(ছয়) স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা।

(সাত) হজের ওয়াজিব সমূহের মধ্য থেকে কোনো ওয়াজিবকে ছেড়ে দেয়া।

(আট) স্থলের কোনো প্রাণীকে ইহরাম অবস্থায় হত্যা করা হারাম। তেমনিভাবে কষ্ট দেয়াও নিষেধ।
হারামে নিষিদ্ধ কাজ দুটি- (এক) হারামের ভেতরের কোনো প্রাণীকে শিকার করা বা কষ্ট দেয়া। ইহা মুহরিম ও হালাল সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। (দুই) হারামের ভেতরের কোনো গাছ বা ঘাস কাটা।

নিষিদ্ধ কাজের ব্যাপারে মৌলিক কিছু নীতিমালা:

(এক) কোনো হাজি সাহেব যদি শরয়ী গ্রহণযোগ্য কোনো ওজর ছাড়া নিষিদ্ধ কাজ করে এবং কাজটি পূর্ণাঙ্গভাবে করে ফেলে তাহলে তার ওপর দম দেয়া ওয়াজিব। এখানে এদিক সেদিক করার কোনো সুযোগ নেই। দম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ছাগল বা ভেড়া অথবা দুম্বা। গরু, উট বা মহিষের সাত ভাগের এক ভাগও এক্ষেত্রে যথেষ্ঠ হবে। পশুর ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর সকল শর্ত বিদ্যমান থাকা জরুরি। একটি পূর্ণ গরু বা উট দম হিসেবে দেয়া দুই সুরতে ওয়াজিব হয়। (এক) ঋতুবর্তী বা বাচ্চা জন্ম দেয়ার পরের নাপাকি অবস্থা কিংবা গোসল ফরজ অবস্থায় তওয়াফে জিয়ারত আদায় করা দ্বারা। (দুই) আরাফার ময়দানে অবস্থানের পর, মাথা মুন্ডানোর পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করার দ্বারা।

 শরয়ী গ্রহণযোগ্য ওজর ছাড়াই নিষিদ্ধ কাজ অপূর্ণাঙ্গভাবে করে ফেললে সদকা করা নির্ধারিত। সদকা বলতে বুঝানো হয়েছে, সদকায়ে ফিতর পরিমাণ গম অথবা তার দ্বীগুণ জব সদকা করা। শরয়ী গ্রহণযোগ্য ওজরের কারণে নিষিদ্ধ কাজ করেছে এবং যদি পূর্ণাঙ্গভাবে করে ফেলে তাহলে তার জন্য তিন বিষয়ের কোনো একটি করার ইখতিয়ার থাকবে। ইচ্ছা হলে দম দিতে পারবে বা সদকা দিয়ে ক্ষতি পূরণ করবে। আর চাইলে তিন দিন রোজাও রাখতে পারবে। আর উক্ত সুরতেই কাজ যদি অপূর্ঙ্গভাবে করে তাহলে একটা রোজা বা সদকা করার ব্যাপারে ইখতিয়ার থাকবে। (সূত্র মুআল্লিমুল হুজ্জাজ-২৩৮)।

(দুই) নাবালেগ বাচ্চা কোনো নিষিদ্ধ কাজ করলে তার ওপর কোনো কিছু ওয়াজিব হবে না এবং তার পক্ষ থেকে অভিভাবকের ওপরও কোনো কিছু ওয়াজিব হবে না।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top