তিনি কিছুটা প্রকাশিত, কিছুটা আ‌লো‌চিত ও বাকিটা রহস্য

S M Ashraful Azom
0
তিনি কিছুটা প্রকাশিত, কিছুটা আ‌লো‌চিত ও বাকিটা রহস্য
সেবা ডেস্ক: যদি ক্যালেন্ডার থেকে ১৯ জুলাই ২০১২ দিনটা মুছে ফেলা যেত! যদি সময়ের মহাকালে দিনটা আর না-ই আসত। যদি ক্যানসার নামক দানবের জন্মই না ঘটত পৃথিবীতে। যদি ১২ বার কেমোথেরাপি দেওয়ার পর অজ্ঞাত ভাইরাসের আগমন না ঘটত। যদি সেই ভাইরাস জীবননাশী না হতো। যদি...
তবে কি আজ বেঁচে থাকতেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাদুকর? কলম আর ক্যামেরা দিয়ে তাঁর জাদু দেখিয়েছেন? কলমকে তিনি বলতেন তাঁর হাতের ষষ্ঠ আঙুল। আর ক্যামেরা? তৃতীয় চোখ।
১৯ জুলাই ২০১২। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে সেদিন মৃত্যু সবচেয়ে অনিবার্য সত্যি হয়ে নেমেছিল তাঁর জীবনে। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। বেঁচে থেকে তিনি তারকা হয়েছেন, আর মৃত্যুতে হয়েছেন নক্ষত্র। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি হিমুদের জন্মদাতা, তিনি মিসির আলীকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি পিতা। জন্মের আগেই যে কন্যা মৃত্যুকে ভালোবেসেছিল, তিনি সেই লীলাবতীর পিতা। তাই পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চলে গেছেন সেখানে, যেখানে রয়েছে তাঁর লীলাবতী।

সেখানেই হয়তো আশপাশে কোথাও অভ্যাসবশত হাতের তর্জনীতে চেইন একবার প্যাঁচাচ্ছেন আর একবার খুলছেন বাকের ভাই। সেখানেও কি চায়ের দোকান আছে? ১ ডজন কাপ চা খেয়ে তিনি কি ক্যাসেট প্লেয়ারে সেই গানটাই ছেড়ে দিয়েছেন, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মলমল...’। বদি যদি মিথ্যে সাক্ষ্য না দিত, তাহলে তো আর ফাঁসি হতো না বাকের ভাইয়ের। ক্যানসার যদি তাঁর শরীরে ভর না করত, তবে কি আজ বেঁচে থাকতেন হুমায়ূন আহমেদ? কে জানে! আচ্ছা সেখানে বাকের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের?

হুমায়ূন আহমেদ তখন পৃথিবীতে আসেননি। তখনো টিনের চালে বৃষ্টি নামত। বর্ষায় কদম ফুটত। ভরা জ্যোৎস্নায় আলোকিত হতো চারপাশ। কিন্তু এসব ঘটে যেত অনেকটা আমাদের অলক্ষ্যে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদই শিখিয়েছেন হৃদয় পেতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে। জানিয়েছেন, যে ছেলেটির কখনো কিছু ইচ্ছে করেনি, তারও কেন যেন ঘুম ঘুম চোখে জ্যোৎস্না রাতে ঘর থেকে বের হয়ে হঠাৎ গৌতম বুদ্ধ হতে ইচ্ছা করে।

আজ সাত বছর, তিনি নেই। দুটো অধিবর্ষ ধরে ২৫৫৭ দিন। কিন্তু ঝুমবৃষ্টির শব্দে তিনি আছেন। এখনো কলাবাগানের গলি দিয়ে হাঁটলে মনে হয়, আশপাশের কোনো এক দোতলায় নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। তাই তিনি আছেন। তিনি তো কোনো উপন্যাস নন, তিনি ছোটগল্প, যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ। আর তাই ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলচ্চিত্রের শেষে মেহের আফরোজ শাওন যখন হুমায়ূন আহমেদকে মনে করে গেয়ে ওঠেন, ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বরষায়’।
মনে হয়, তিনি যাননি কোথাও। আশপাশেই আছেন। অভিমান ভাঙলে এক বরষায় সত্যিই এসে হাজির হবেন। যখন বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে কাগজের তৈরি হুমায়ূন আহমেদ গালে হাত দিয়ে গম্ভীরভাবে ভাবেন আর ৭ থেকে ৭০, সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে, মনে হয় তিনি আছেন।
হুমায়ূন আহমেদ প্রায় পুরোটা সময়ই লেখক ছিলেন, সেই সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। মাঝেমধ্যে নাটক, চলচ্চিত্র বানাতেন। চিত্রনাট্য লিখতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিউইয়র্কে বসে আকাশ এঁকেছেন। রংতুলির আঁচড়ে রঙিন করতে চেয়েছিলেন ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসের শেষ ধূসর দিনগুলো।

হুমায়ূন আহমেদের হাতে ছিল জাদুর স্পর্শ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মৃত্যুতে দেশে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। কারও কাছে তিনি রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল, কারও মতে তিনিই শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয়, তিনি কিংবদন্তি। আর কারও মতে তিনি কেবলই জাদুকর। সেই জাদুকর, যিনি একদিন মনস্থির করলেন, অধ্যাপনা ছেড়ে সিনেমা বানাবেন। আর যেই ভাবা সেই কাজ।

চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে তিনি আটটি ছবি নির্মাণ করেছেন। তাঁর প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের নির্মিত এই ছবি ৮টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এর ৭ বছর পর ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। এ ছবিতে বিয়ের দিন বিষ পান করে কুসুম। মাঝনদীতে কুসুমের প্রাণটা যখন পাখি হয়ে মহাসিন্ধুর ওপারে চলে যায়, ঠিক তখনই মতি গাতক দরাজ গলায় গেয়ে ওঠেন, ‘শুয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি...’।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘দুই দুয়ারি’। এই ছবির রহস্যমানব রিয়াজ সে বছর জয় করেন সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তি পায় ‘চন্দ্রকথা’ আর ‘শ্যামল ছায়া’। চন্দ্রকথায় চন্দ্রর প্রেম এক সাধারণ, ভীতু জহিরকে করে তোলে সাহসী আর প্রতিবাদী। আর ৭৬তম অস্কার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ‘শ্যামল ছায়া’।
এরপর ২০০৯ সালে মুক্তি পায় ‘নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত’। এই কমেডি ছবির পুরোটা শুটিং হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে তৈরি নুহাশপল্লীতে। সেখানে মাটিতে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন তিনি। এরপর তিনি নির্মাণ করেন ‘আমার আছে জল’। এই ছবি দিয়ে বড় পর্দার যাত্রা শুরু করেন ‘লাক্স সুন্দরী’ বিদ্যা সিনহা সাহা মিম। আর হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর ২০১২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।

ব্রিটিশ আমলের কথা। হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি ছবির কাহিনি। তখন মেয়েদের পোশাক পরে কিছু সুন্দর মুখের কিশোরদের নাচগান করার রীতি চালু ছিল। আঞ্চলিক ভাষায় এই কিশোরদের ডাকা হতো ঘেটু। বিত্তবানেরা এই কিশোরদের সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। একসময় বিষয়টি সামাজিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়ে যায়। নারীর বেশে সেই কিশোরদের বিত্তবানদের স্ত্রীরা সতিন হিসেবে দেখতেন। সে রকমই একজন ঘেটুপুত্র কমলা।

ছবিটি পাঠানো হয় ৮৪ তম অস্কারে। মৃত্যুর শেষ মুহূর্তেও তিনি কথা বলেছেন মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এই ছবি নিয়ে। মৃত্যুশয্যায় প্রযোজক ফরিদুর রেজা সাগরকে বলেছিলেন, ছবিটি ভালো হয়েছে। এটাকে যেন টেলিভিশনে প্রিমিয়ার না করে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয়। সারা দেশে একসঙ্গে। কথা রেখেছিলেন প্রযোজক।

যা হোক, লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সমাহিত হন একজন পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ। এই কলম জাদুকর যদি কোনো জাদু বলে ক্যানসারকে জয় করতে পারতেন, তাহলে এখন তার বয়স হতো ৭০। এ আর এমন কী। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর নুহাশ নিথর বাবাকে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু পুত্র হয়ে নয়, এসেছিলেন হলুদ পাঞ্জাবি পরে, খালি পায়ে, হিমু হয়ে। বেঁচে থাকলে দেখতেন, হিমুরা এখনো রাস্তায় ঘুরে ফেরে। রূপারা বৃষ্টিতে ভেজে। আর তাতে ধুয়ে যায় সব বিষাদ। আর শুভ্ররা চশমার মোটা ফ্রেমের কাচ পরিষ্কার করতে করতে জরীদের প্রেমে পড়ে।

এভাবেই তিনি বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। তাঁর বইয়ের নতুন সংস্করণের প্রিন্টের ঘ্রাণে, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের ভেতর, নাটকে, চলচ্চিত্রে। তিনিই হিমু, তিনিই মিসির আলী আর তিনিই হুমায়ূন আহমেদ; যাঁর কিছুটা প্রকাশিত, কিছুটা গুজব আর বাকিটা রহস্যময়। যদিও আজ মৃণ্ময়ীর মন ভালো নেই। মন ভালো নেই তিথিরও। তবু আজ কোনো শোকগাথা নয়।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top