ইসলামে মদ্যপান, জুয়া, বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর নিষিদ্ধ

S M Ashraful Azom
0
ইসলামে মদ্যপান, জুয়া, বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর নিষিদ্ধ
সেবা ডেস্ক: ‘মদ্যপান, জুয়া খেলা, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়।’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৯০)।

মদ, জুয়া নিষিদ্ধের কারণ হিসেবে মায়েদাহ ৯১ আয়াতে আল্লাহ বলেন যে, শয়তান এর মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর স্মরণ হতে ও সালাত হতে তোমাদের বিরত রাখে।’ অতএব যেসব খেলা পরস্পরে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি করে এবং সালাত ও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে, সে সব খেলায় আর্থিক জুয়া থাক বা না থাক, তা অবশ্যই নিষিদ্ধ এবং তা মাইসির এর অন্তর্ভুক্ত।
ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বলেন, كُلُّ مَا أَلْهَى عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ، فَهُوَ مِنَ الْمَيْسِرِ- ‘প্রত্যেক বস্ত্ত যা আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত হতে মানুষকে ভুলিয়ে রাখে, সেটাই ‘মাইসির’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)।

ইমাম কুরতুবী বলেন, প্রত্যেক খেলা যা আপোষে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে এবং সালাত ও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে, তা মদ্যপানের ন্যায় এবং তা হারাম হওয়া ওয়াজিব। আর এটা জানা কথা যে, মদ মানুষকে নেশাগ্রস্তকরে। কিন্তু জুয়া নেশাগ্রস্ত করে না। এতদসত্ত্বেও এদু’টিকে আল্লাহ সমভাবে হারাম করেছেন মর্মগত দিক দিয়ে দু’টির পরিণতি একই হওয়ার কারণে। দ্বিতীয়তঃ স্বল্প পরিমাণ মদ মাদকতা আনে না, যেমন দাবা ও পাশা খেলা মাদকতা আনে না। তবুও অল্প পরিমাণ মদ যেমন হারাম বেশি পরিমাণের ন্যায়। ওইসব খেলাও তেমনি হারাম। তৃতীয়তঃ মদ্যপানের পর মাদকতা আসে ও তা সালাত থেকে উদাসীন করে। পক্ষান্তরে খেলার শুরুতেই উদাসীনতা আসে, যা হৃদয়ের ওপর মদের ন্যায় আচ্ছন্নতা নিয়ে আসে। ফলে মদ ও খেলার ফলাফল একই হওয়ার কারণে একইভাবে দু’টিকে হারাম করা হয়েছে।  (তাফসীর কুরতুবী, মায়েদাহ ৯০)।

অতএব উপরোক্ত শর্তাদি পাওয়া গেলে সকল ধরনের খেলা-ধূলা হারাম বলে গণ্য হবে। এইসব কাজে অর্থ দিয়ে, সময় ও শ্রম দিয়ে, বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা ও উৎসাহিত করা অন্যায় ও পাপাচারে সহযোগিতা করার শামিল। যা ইসলামে নিষিদ্ধ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ২)। আল্লাহ বলেন, إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلاً ‘নিশ্চয়ই তোমার কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটি সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন তুমি জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা: বনু ইস্রাঈল, আয়াত: ৩৬)।

(৩) اَلْأَنْصَابُ একবচনে النَّصَبُ ‘নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করানো কোনো ঝান্ডা বা স্তম্ভ’ (মিছবাহ)। একবচনে النُّصُبُ হতে পারে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ ‘যা বেদীতে যবহ করা হয়’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত:  ৩)। ইবনু আববাস, মুজাহিদ, আত্বা প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন,هِيَ حِجَارَةٌ كَانُوْا يَذْبَحُوْنَ قَرَابِيْنَهُمْ عِنْدَهَا এটি হলো সেই সব পাথর, যেখানে জাহেলী যুগের আরবরা পশু কোরবানী করত (ইবনু কাছীর)। ইবনু জুরায়েজ বলেন, লোকেরা মক্কায় এগুলো যবহ করত। অতঃপর বায়তুল্লাহর সামনে এগুরোর রক্ত ছিটিয়ে দিত ও গোশত বেদীর মাথায় রাখত। এ সময় কাবার চারদিকে ৩৬০টি এরূপ বেদী ছিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। এগুলোর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য কামনা করত। ইসলাম আসার পর এগুলোকে হারাম ঘোষণা হয়। যদিও যবহের সময় তার ওপরে আল্লাহর নাম নেয়া হয় (ইবনু কাছীর)। কেননা এর ফলে ওই পাথরকে সম্মান করা হয় (কুরতুবী)। যা স্থানপূজার শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

বর্তমান যুগে বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার কবরে ‘হাজত’ দেয়ার নামে যেসব পশু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে যবহ করা হয়, তা উক্ত শিরকের অন্তর্ভুক্ত। যা স্পষ্টভাবে হারাম। একইভাবে শহীদ বেদী, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি যেখানেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়, সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

(৪) اَلْأَزْلاَمُ একবচনে زَلَمٌ বা زُلَمٌ অর্থ পাখনা বিহীন তীর, ভাগ্য নির্ধারণী তীর। এখানে জুয়ার তীর বা শর। যার মাধ্যমে জাহেলী যুগের আরবরা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করত। ইবনু কাছীর বলেন, আরবদের নিকট ‘আযলাম’ ছিল দু’ধরনের। একটি ছিল ভাল-মন্দ নির্ধারণ করার জন্য। অন্যটি ছিল জুয়া। অত্র আয়াতে জুয়াকে হারাম করা হয়েছে। এর বিপরীতে ভাল-মন্দ নির্ধারণে আল্লাহর শুভ ইঙ্গিত কামনা করে সালাতুল ইস্তিখারাহ আদায়ের নির্দেশ এসেছে হাদিসে। (বুখারী, আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৩২৩ ঐচ্ছিক ছালাত অনুচ্ছেদ-৩৯)। ফলে উভয় অবস্থায় ‘আযলাম’ নিষিদ্ধ করা হলো।

অন্য আয়াতে একে فِسْقٌ অর্থাৎ পাপকর্ম বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيْحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلاَمِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ

‘তোমাদের ওপর হারাম করা হলো মৃত প্রাণী, (প্রবাহিত) রক্ত, শূকরের গোশত, যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গীত হয়েছে... এবং জুয়ার তীর দ্বারা যেসব অংশ তোমরা নির্ধারণ করে থাক। এসবই পাপ কর্ম’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৩)। ইবনু জারীর বলেন, الاستقسام অর্থ طلب القسم অংশ দাবী করা।

জাহেলী যুগে ‘আযলাম’ ছিল তিন ধরনের। যেমন একটি তীরে লেখা থাকত إِفْعَلْ ‘তুমি কর’। একটিতে লেখা থাকত لاَ تَفْعَلْ ‘করো না’। আরেকটিতে কিছুই লেখা থাকত না। অতঃপর যে ব্যক্তি যেটা তুলত, সেটাকেই সে আল্লাহর নির্দেশ মনে করত। কিন্তু যখন খালিটা হাতে উঠত, তখন সে পুনরায় লটারি করত। যতক্ষণ না আদেশ বা নিষেধের তীর হাতে আসত (ইবনু কাছীর)।

মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা.) কাবা গৃহে প্রবেশ করে ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের মূর্তিতে তাদের হাতে ধরা ভাগ্যতীর দেখতে পান। তিনি সেগুলো হটিয়ে দিয়ে বললেন, لَقَدْ عَلِمُوْا مَا اسْتَقْسَمَا بِهَا قَطُّ ‘আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন। ওরা ভাল করেই জানে যে, এ দু’জন ব্যক্তি কখনোই এভাবে ভাগ্য নির্ধারণ করতেন না।’ (আহমাদ, বুখারী হা/৪২৮৮)।

বর্তমান যুগে পাখির মাধ্যমে বা রাশি গণনার মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। কেউ শান্তির প্রতীক মনে করে পায়রা উড়িয়ে শুভ কামনা করেন। কেউ বিশেষ কোনো দিন বা সময়কে শুভ ও অশুভ গণ্য করেন। কেউ মৃত পীরের খুশী ও নাখুশীকে মঙ্গল বা অমঙ্গলের কারণ বলে ধারণা করেন। এসবই ‘আযলামের’ অন্তর্ভুক্ত যা নিষিদ্ধ এবং স্পষ্টভাবে শিরক।

আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত চারটি বস্ত্তর মধ্যে প্রধান হলো ‘মদ’। চাই তা প্রাকৃতিক হোক বা রাসায়নিক হোক। প্রাকৃতিক মদ যেমন, পানীয় মদ, তাড়ি, আফিম, গাঁজা, চরস, হাশিশ, মারিজুয়ানা ইত্যাদি এবং তামাক ও যাবতীয় তামাকজাত দ্রব্য। রাসায়নিক মদ, যেমন হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, মরফিন, প্যাথেড্রিন, ইয়াবা, সীনেগ্রা, আইসপিল এবং সকল প্রকার মাদক দ্রব্য। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের ও বিভিন্ন নামের অগণিত বাংলা মদ ও বিদেশি মদ।

মাদকের কুফল: বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে তামাকজাত দ্রব্য এবং মাদক দ্রব্য। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ তরুণ-তরুণীদের জীবন ও পরিবার এবং ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। সেই সঙ্গে মাদক ব্যবসা বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে  লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হওয়ায় চোরাকারবারীরা এই ব্যবসায়ের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ভৌগলিক কারণে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্রটি ইচ্ছাকৃতভাবে এদেশের উঠতি বয়সের তরুণদের ধ্বংস করার নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য তাদের সীমান্তে অসংখ্য হেরোইন ও ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছে এবং সেখানকার উৎপাদিত সব মাদক দ্রব্য এদেশে ব্যাপকভাবে পাচার করছে উভয় দেশের চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান পথের কমপক্ষে ৩০টি রুট দিয়ে এদেশে মাদক আমদানী ও রফতানী হচ্ছে। ফলে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সরকারী মাদক অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট মাদকাসক্তের ৯০ শতাংশই কিশোর, যুবক ও ছাত্র-ছাত্রী। যাদের ৫৮ ভাগই ধূমপায়ী। ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তদের গড় বয়স কমতে কমতে এখন ১৩ বছরে এসে ঠেকেছে। আসক্তদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩৭ বছরের মধ্যে। এইসঙ্গে বিস্ময়কর তথ্য হলো এই যে, দেশের মোট মাদকসেবীর অর্ধেকই উচ্চ শিক্ষিত। এভাবে ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও দিন-মজুর, বাস-ট্রাক, বেবীট্যাক্সি ও রিকশাচালকদের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপকভাবে মাদকাসক্তি। আর এটা জানা কথা যে, মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

বর্তমান বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি তামাকসেবীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ হলো নারী। বাংলাদেশের ৪৩ ভাগ লোক তামাকসেবী। আর তামাক ব্যবহারকারীদের শতকরা ৫৮ ভাগ হলো পুরুষ ও ২৯ ভাগ নারী। ধোঁয়াবিহীন তামাকসেবী নারীর সংখ্যা শতকরা ২৮ এবং পুরুষের সংখ্যা ২৬। অর্থাৎ নারীরা তামাক-জর্দা-গুল ইত্যাদি বেশি খায় এবং পুরুষেরা বিড়ি-সিগারেট বেশি খায়। সম্ভবতঃ লোক-লজ্জার ভয়ে নারীরা প্রকাশ্য ধূমপান থেকে বিরত থাকে। কিন্তু পুরুষদের মধ্যে এই লজ্জা দিন-দিন কমে যাচ্ছে। এমনকি দাড়ি-টুপীওয়ালা ব্যক্তিও এখন প্রকাশ্যে ধূমপানে লজ্জাবোধ করে না। ফলে তাদের দেখাদেখি সাধারণ লোকেরা আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ওইসব দাড়িওয়ালা ধূমপায়ীরা অন্যদের চেয়ে বেশি পাপের অধিকারী হবে।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top