বাঙালির ইতিহাস নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

S M Ashraful Azom
0
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the history maker of Bengali
সেবা ডেস্ক: বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস নিয়ে কোন বিষয় উঠে আসলে সবার আগে যে নামটি উঠে আসে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যার এক তর্জনির ইশারায় একটি জাতি পায় স্বাধীনতা। স্বধীন ভূখণ্ড।
 একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যারা দেখেছেন; তাদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে রয়েছেন তারা এর সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধ তো তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। কিন্তু বড়ই আশ্চর্য এবং পরিতাপের বিষয় যে, পনের আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যে গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র ও অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি এবং পাকিস্তানের সমর্থক ছিল তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে শুরু করল। বলা যেতে পারে, এই প্রক্রিয়া গত ২০-২১ বছর ধরে চলে এসেছে।  ফলে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বন্ধে নানারকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু নতুনদের মাঝে তো সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। ইতিহাসের গবেষকরা যেসব উৎসের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করে থাকেন সেগুলো হলো প্রধানত লিখিত দলিল, পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা, চিঠিপত্র, ডায়রি ইত্যাদি। মৌখিক ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রি এসব থেকে ভিন্ন এই অর্থে যে, এটি মৌখিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি যেসব মানুষকে জেনেছেন বা যেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বা যেসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেসব বিষয়ে তথ্য প্রদান করেন। তবে এ ধরনের মৌখিক তথ্য লিখিত দলিলের বিকল্প নয়, এগুলো হলো তার পরিপূরক।

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ব্যাপক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির সর্বকালের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। বাঙালির এই মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পাকিস্তান আমলে আমাদের এই অঞ্চলটাকে পূর্বপাকিস্তান বলা হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকসামরিক শাসকগোষ্ঠীর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে এই অঞ্চলকে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করতে শুরু করলেন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাকে তিনি জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এটি ছিল এই বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের দীর্ঘকালের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। এই আন্দোলনটা ছিল প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট আন্দোলন। আধুনিক জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজম ভূভিত্তিক চেতনা থেকে উদ্ভূত। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের আত্মপরিচয় এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভয়-ভাবনা সম্বন্ধে সম্মিলিত চেতনা বা ‘কালেকটিভ কনশিয়াসনেস’ হলো জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। এই জাতীয় চেতনা ধর্মভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক বা সম্প্রদায়ভিত্তিক চেতনা নয়। এটি হলো প্রধানত এবং মূলত অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এই অর্থে যে, একটি ভূখণ্ডের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের আত্মপরিচয়; নিজেদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে সম্মিলিত চেতনা থেকে এই জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। 

এমন মধুর ইতিহাসের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি বাংলাদেশকে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন এভাবে- শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি,  ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ শুনবেন’ বলে তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বলেন, ‘সেটা ১৯৪৭ সাল। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কি না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত।’ বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনো উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার চাওয়া কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলি যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করতো। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে।

ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকাদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক-বাংলা। কেউ বলে পূর্ণ বাংলা। আমি বলি, না, বাংলাদেশ। এটাই শেষ কথা। তারপর আমি স্লোগান দেই, জয় বাংলা। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারে নাই। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়। যা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।’

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top