গাইবান্ধার ঝিনুকের তৈরী চুন উৎপাদনকারি যুগিরা বিপাকে

S M Ashraful Azom
0
Patients who produce limestone made from Gaibandha oysters are in danger
গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি: বাংলার পান সুপারি এখনও এদেশের গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। বিয়ে-সাদী এমনকি যে কোন খানাপিনা ও মেহেমানদারীতেও পান সুপারী পরিবেশন একান্ত অপরিহার্য একটি উপাদান। এই পান খেয়ে মুখ লাল করতে এবং পান সুপারীর ঝাল এবং কষ্টা ভাবটা দুর করে একে মুখরোচক করতে যে উপাদানটি কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে ঝিনুকের চুন। এই চুন ছাড়া পান খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। খাল, বিল, নদী থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে, নানা পদ্ধতিতে যারা চুন তৈরী করে তারা হলো যুগি স¤প্রদায় বা চুনারু নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ কারণে পান খাওয়ার এই ঝিনুক চুনকে যুগির চুনও বলা হয়। হিন্দু স¤প্রদায়ের কতিপয় যুগি পরিবার এখনও গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় তাদের আদি পেশাকে আঁকড়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। আর সরবরাহ করছে পান সুপারীর রসনা তৃপ্তির সহযোগী উপাদান ঝিনুকের চুন।

গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদনকারি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পেশাজীবি পরিবার এখনও নানা সমস্যা সংকট নিরসন করেও পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে তাদের জীবিন জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিলে ঝিনুকের সংখ্যা কমে যাওয়া, চুনা পাথর থেকে তৈরী চুনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় যুগিদের তৈরী যুগির চুনের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। তদুপরি ঝিনুকের চুনের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে পেশাদার যুগিরা জীবন জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
 Patients who produce limestone made from Gaibandha oysters are in danger
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালুয়ার বাজার সংলগ্ন জলেরমোড়ের যুগিপাড়া গ্রামটি এই ঝিনুকের চুনের কারিগরদের কারণে ইতোমধ্যে চুনের গ্রাম নামেই সর্বাধিক পরিচিত অর্জন করেছে। এই যুগিপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রায় ১শ’ ৩০টি পরিবারের বসতি ছিল। যারা ঝিনুকের চুন তৈরী করে খুব স্বচ্ছল জীবন যাপন করতো। কেননা, সে সময় চারদিকে নদী বেষ্টিত এ জেলায় ঝিনুক পাওয়া যেত অনেক বেশী। সে জন্য চুনও উৎপাদিত পরিমাণও ছিল নেহায়েত কম নয়। এছাড়া পাথরের চুনের ব্যবহারের প্রচলনও তখন শুরু হয়নি। উৎপাদিত চুন এখান থেকে যেতো পার্শ্ববর্তী জেলায়। ফলে দাম বেশী পাওয়া যেতো বলে তখন চুনের কারবার ছিল রমরমা। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই।

স¤প্রতি রামচন্দ্রপুরের যুগিপাড়ায় মাত্র ১৫টি পরিবার তাদের পুরাতন এই চুন তৈরীর পেশাকে আঁকড়ে রেখেছে। পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে এই চুন তৈরীতে নিয়োজিত থাকে। যুগিরা ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী বালাসীঘাট, কামারজানি, করতোয়া নদীর বড়দহ ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে নদীর ঝিনুক কেনে। মাছ ধরার সময় জালে যে ঝিনুক ওঠে, স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে বলা হয় ‘সিপি’ বা ‘টোকরাই’। জেলেরা তা জমা করে রাখে যুগিদের জন্যই। প্রতিমণ ঝিনুক যুগিরা কেনে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দরে। তারপর এগুলোকে তারা গরম পানিতে সিদ্ধ করে। যাতে সেগুলো মরে যায় এবং এতে সহজেই খোলস দুটো ফাঁক হয়ে খুলে যায়। এরপর যুুুুগি পরিবারের মেয়েরা প্রতিটি ঝিনুক থেকে ভেতরের নরম অংশগুলো বের করে নেয়। যা হাঁস-মুরগীর অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং প্রিয় খাবার হিসেবে হাঁস-মুরগী খামারীদের কাছে বিক্রি হয়।
Patients who produce limestone made from Gaibandha oysters are in danger
এ অবস্থায় ঝিনুক এর খোলসগুলো পানিতে ধুয়ে পরিস্কার করে রোদে শুকানো হয়। সবশেষে চুনের ভাটিতে আগুনে পুড়িয়ে তা ছাঁই করা হয়। ভাটিতে আগুনের উত্তাপ বৃদ্ধির জন্য সাইকেলের চাকায় তৈরী একটি বিশেষ হাঁপর চালিয়ে ভাটিতে বাতাস দেয়া হয়। ঝিনুক বা টোকরাইয়ের এই ছাঁইগুলো বড় মাটির পাত্রে রেখে তাতে পানি মিশিয়ে বাঁশের লাকড়ি দিয়ে ঘুটিয়ে ঘুটিয়ে তৈরী করা হয় পানে খাওয়ার সেই কাংখিত চুন। গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জলের মোড় যুগিপাড়া গ্রামের যুগিরা জানালেন, ১ মণ ঝিনুক থেকে ২ মণ চুন হয়। ১ মণ ঝিনুকের চুন তৈরী করতে সময় লাগে ৩ দিন।এই চুন তারা প্ল¬াষ্টিকের ক্যানে ভরে মাথায় নিয়ে অথবা সাইকেলে করে পানের দোকানে দোকানে ফেরী করে প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করে। এছাড়া ঝিণুকের কোমলাংশ এবং চুন বিক্রি করে খরচ বাদে লাভ হয় ৫শ’ ৮০ টাকা থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা। যা দিয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জলেরমোড়ের যুগিপাড়ার যুগিরা জানালেন, তাদের দাবি আর্থিক কারণে তারা আদি এই গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়া হলে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে এবং তারা এতদঞ্চলের খাল-বিল-নদী-নালা থেকে প্রাপ্ত সাধারণ এই ঝিনুকের চুন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারবে।

এছাড়া পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতায় খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় নদী-নালা-খাল-বিল থেকে এখন আর সহজেই ঝিনুক পাওয়া যায় না। ফলে জেলার বাইরে থেকেও বেশী দামে ঝিনুক কিনে আনতে হয়।  এতে চুনের উৎপাদন খরচ পড়ে যায় অনেক বেশী। তদুপরি ইদানিং সমুদ্রের শংখ এবং সাদা রংয়ের ঝিনুক থেকেও চুন তৈরী হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বগুড়াসহ অন্যান্য জেলায়। সেখানে শংখ এবং সাদা ঝিনুকও কিনতে পাওয়া যায়। সামুদ্রিক শংখ এবং সাদা ঝিনুক থেকে যে চুন হয় তার রং এমনিতে হয় সাদা। ইদানিং কোথাও কোথাও এসিড মিশিয়ে সাধারণ ঝিনুকের চুনের মত সাদা ধবধবে করা হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আবার এইসব সাদা চুনের চাহিদাও অনেক বেশী। এতে দামও পাওয়া যায় অনেক বেশী। কিন্তু দরিদ্র এই যুগিদের চুনে কোন কেমিকেল মেশানো হয় না বলে তার রং হয় একটু কালচে। ফলে সংগত কারণে ধব্ধবে এই সাদা শংখের চুনের দাম বেশী হলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না যুগিদের বানানো ঝিনুকের চুন।


 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top