আশ্চর্য এক মহামানব, লোকমান হাকিম

S M Ashraful Azom
0
আশ্চর্য এক মহামানব, লোকমান হাকিম
সেবা ডেস্ক: টাকা পয়সা, সোনা-গহনা বা জমা-জমি নয় বরং জ্ঞানই হচ্ছে ব্যক্তির স্থায়ী সম্পদ। হাজার হাজার বছর পরেও সকলের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন লোকমান হাকিম। তা কোন অমূল্য সম্পদের অবদান বলতে পারবে?
জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই লোকমান হাকিমকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। অনন্তকাল জ্ঞানপিপাসুরা তার জ্ঞান দ্বারা তৃষ্ণা  নিবারণ করবে।

ইতিহাসে বিতর্কের উর্ধ্বে লোকের সংখ্যা একেবারেই নগন্য। কারো কাছে কেউ হিরো হলে, অন্য কারো কাছে হয়ে থাকে সমালোচিত। ব্যক্তির কাজ, আদর্শ, চিন্তা ও অবদানের কারণেই মূলত এই বিতর্ক। সমালোচনার উর্ধ্বে উঠতে হলে, ব্যক্তিকে হতে হয় সকল ক্ষেত্রে আদর্শ, সর্বজন স্বীকৃত। এমন একজন ব্যক্তি হচ্ছেন লোকমান হাকিম। ধর্মীয় ইতিহাস ও বিশ্ব ইতিহাসে তিনি সকলের কাছে সমানভাবে সমাদৃত।

আফ্রিকাকে বলা হয় দুর্ভিক্ষের মহাদেশ। দারিদ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই আফ্রিকার মিসরিয় সভ্যতা পৃথিবীতে এক সময় ছিল সবার মডেল। শিক্ষা-দীক্ষা, আবিস্কার ও উন্নতির চরম পর্যায়ে উন্নতি পেয়েছিল এই সভ্যতা। আফ্রিকারই আরেকটি অঞ্চল হচ্ছে হাবশা। যার বর্তমান নাম ইথুপিয়া। ইসলামের প্রথম হিজরত স্থল, সেখানকার বাদশা নাজাসির ইসলাম গ্রহণ ও আল্লাহর রাসূলের (সা.) প্রসিদ্ধ সাহাবি বেলাল (রা.) এর জন্মস্থান হওয়ার দরুন মুসলমানদের কাছে পরিচিত। আমাদের আলোচিত ব্যক্তি লোকমান হাকিম (আ.)-ও ছিলেন সেই হাবশার বাসিন্দা। হাবশীরা কালো ও মোটাঠোট বিষিষ্ট হয়ে থাকে। তা সত্তেও আজও লোকমান হাকিমের সুনাম ও নসীহতপূর্ণ কথা পুরো বিশ্বে পরিচিত। এর দ্বারা বুঝা যায়, জ্ঞান ও বুদ্ধি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, বংশ বা সম্পদ দিয়ে অর্জনের বিষয় নয়। দুনিয়ার যে কোনো অঞ্চলে, বংশ বা জাতে জ্ঞানি ব্যক্তি জন্ম নিতে পারেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার সদ্য পরোলোকগত নেতা ম্যান্ডেলাও তো কালো ছিল। কিন্তু সততা ও আদর্শ দিয়ে সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছেন। এ বিষয়ে সাহাবি আবু দারদা থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেখানে তিনি বলেছেন, লুকমান হাকিমকে যা দেয়া হয়েছে তা তার পরিবার, মাল, বংশ বা স্বাভাবিক কোনো আদতের কারণে দেয়া হয়নি। বরং বিশেষ কিছু গুণাবলি, যা তার মাঝে ছিল সেগুলোর উসিলায় বিশ্বের অদ্বিতীয় জ্ঞানি হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সে গুণগুলো সামনে আলোচনা হবে।

লুকমান হাকিম পেশাগত দিক থেকে ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। সামান্য আয়ের মানুষ হলেও তিনি কখনো অর্থের জন্য অনৈতিক কাজে জড়াননি। সৎভাবে অর্জিত অর্থ দিয়েই তিনি জীবন চালাতেন। লোকমান হাকিমকে একলোক এসে বলে, তুমি ওই ব্যক্তি না, যে আমার সঙ্গে মাঠে ছাগল চড়িয়েছ? আচ্ছ বলো তো, তুমি এত বড় হলে কীভাবে, লোকজন দূরদূরান্ত থেকে তোমার কথা শুনার জন্য আসে এবং তোমার এত বড়বড় মজলিস বসে? উত্তরে তিনি দুটি গুণের কথা বলেন। দুটি গুণের কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাকে এত বড় করেছেন। (এক) সদা সত্য কথা বলা। (দুই) অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা।

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, লোকমান হাকিম বলেছেন, যে গুণগুলোর কারণে আল্লাহ তায়ালা আমাকে এত ওপরে উঠিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি যদি সেগুলো অর্জন করতে পারেন তাহলে সেও আমার মতো মর্যাদার আসনে সমাসিন হতে পারবেন। সে গুণগুলো হচ্ছে, নিজের দৃষ্টিকে নিচের দিকে রাখা, জবানকে বন্ধ রাখা তথা চুপ থাকা, হালাল আয়ের ওপর সন্তুষ্ট থাকা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করা, সত্য কথা বলা, অঙ্গিকার পূর্ণ করা, মেহমানের ইজ্জত করা, প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়া, অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।

তাফসিরে মাআরেফুল কুুরআনে ইবনে কাসিরের সনদে এই কথাগুলো লেখা আছে। সাহাবি আবু দারদা (রা.) এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি ছিলেন নিরবতা অবলম্বণকারী, সর্বদা চিন্তায় নিমগ্ন ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি। দিনে কখনো ঘুমাতেন না। কেউ তাকে থুথু ফেলা, নাক পরিস্কার ইত্যাদি মানবিয় কাজ করতে দেখেননি (অর্থাৎ এগুলো তিনি নিরবে সেরে ফেলতেন)। (ইবনে কাসির) আজ আমাদের মাঝে এই গুণগুলোর অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে অধিকাংশই অনুপস্থিত। আমরা অনেকেই সন্তানকে বড় ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলতে চাই। বড় হতে এই গুণগুলোর বিকল্প নেই।

লুকমান হাকিম নবী ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। ইবনে কাসির (রাহ.) এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী ছিলেন না। হজরত ইকরিমা (রা.) থেকে এক বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু মুফাস্সিরগণ ওই বর্ণনাকে দুর্বল বলেছেন। তিনি হজরত আইউব (আ.) এর আত্মীয় ছিলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে তিনি আইউব (আ.) এর খালাত ভাই ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক লম্বা জীবন দান করেছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) এর যুগ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। তিনি নবী হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য থাকলেও আল্লাহ তায়ালার বিশেষ বান্দা হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো ভিন্নমত নেই। হজরত লোকমান (আ.) সকলের কাছে হাকিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাকিম মানে হচ্ছে যার থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বের হয়। তার কথা ছিল অর্থবহ। মানুষের মাঝে এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। এখনো মানুষ তার কথাকে বাণী হিসেবে লিখে রাখে। তার কৃতিত্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ঠ যে, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার কথাকে কোরআনে মানুষের নসিহত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এবং আল কোরআনের একটি সূরার নাম রাখা হয়েছে লুকমান।

হজরত কাতাদা (রাহ.) থেকে লুকমান (আ.) সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা হজরত লুকমান হাকিমকে দুটি বিষয়ের যে কোনো একটি গ্রহণের এখতিয়ার দিয়েছিলেন। বিষয় দুটি হচ্ছে নবুওয়াত ও হেকমত। হজরত লুকমান (আ.) হেকমতকে কবুল করেন, নবুওয়াতকে গ্রহণ করেননি। কেউ একজন তাকে এর কারণ জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, ‘যদি আমাকে নবুওয়াত দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হত; তাহলে আমি তা গ্রহণ করলে আল্লাহর সাহায্য পেয়ে তাতে সফল হতাম। কিন্তু তা চূড়ান্ত না করে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, যে কারণে এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমি শঙ্কিত ছিলাম। তাই আমি হেকমতকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা গ্রহণ করেছি।’

রাসূল (সা.) এর এক বর্ণনায় এসেছে, কোনো ব্যক্তিকে প্রার্থি হওয়া ছাড়া যদি দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে সেখানে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য আসে। আর কোনো ব্যক্তি যদি দায়িত্ব নিজ ইচ্ছা থেকে চেয়ে নেয় তাহলে সেখানে কোনো রহমতের বিষয় থাকে না। হজরত লুকমান হাকিম হয়ত এই দিকে লক্ষ করতেন যে, আমার জন্য নবুওয়াতের দায়িত্ব যেহেতু চূড়ান্ত করা হয়নি তাই এখন তা নিলে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা হবে। আর তখন আল্লাহ তায়ালার রহমতের আশা করা যায় না।
আজ সমাজের অবনতির দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাব, যে ব্যক্তি দায়িত্বের ব্যাপারে যত বেশি অযোগ্য সে ততবেশি তার প্রত্যাশি। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সুফল হচ্ছে অশিক্ষিতরাও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব প্রাপ্তির প্রত্যাশা করতে পারে। এটা কেমন যেন ডাক্তার না হয়েও অপারেশনের সুযোগ তলব! আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

আল কোরআনে লুকমান হাকিমের কয়েকটি প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। সেখানে আল্লাহ তায়ালার তাওহিদের আলোচনা রয়েছে। এর সঙ্গে কয়েকটি সামাজিক বিষয়ের আলোচনাও করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে ‘আর (কথা বলার সময়) মানুষের দিক থেকে চেহারা অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখ না’ অর্থাৎ কথা বলার সময় শ্রোতার দিকে ফিরে হাসিমুখে কথা বলা। ইসলামের সামাজিক শিক্ষার নির্দেশও এমনই। কথা বলার সময় চেহারা অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখা অভদ্রতা ও অসামাজিকতার পরিচায়ক। তাছাড়া এর দ্বারা ব্যক্তির ভেতরগত অহংকারবোধও ফুটে ওঠে যে, আমি বড় মানুষ, ওরা ছোটলোক, ওদের সঙ্গে কথা বলা আমার মর্যাদার সঙ্গে যায় না। হাটা চলার সামাজিকতা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তিনি মধ্যম গতিতে চলার কথা বলেছেন, যা ভদ্রতার পরিচায়ক। চলার গতি অতিদ্রুত বা একেবারে আস্তে না হওয়া। কারণ উভয়টিতে ক্ষতি ও অসামাজিকতা রয়েছে। ইসলাম শুধু রাস্তায় মধ্যম গতিতে চলার কথা বলে না। বরং জীবন চলার পথে মধ্য গতিতে চলতে বলে। যেমন সূরা বনি ইসরাইলে আয় ও খরচ সংক্রান্ত নীতি বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আর তুমি তোমার হাত নিজ ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখো না (অর্থাৎ খরচ করা বন্ধ করে দিয়ো না) এবং তা সম্পূর্র্ণরূপে উন্মুক্তও করে দিয়ো না (অর্থাৎ বেহিসাব খরচ করা আরম্ভ করো না)। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (বনি ইসরাইল-২৯)

লুকমান হাকিমের আরেকটি সামাজিক শিক্ষা ছিল কথা বলার সময় আওয়াজকে নিচু রাখা। অনেকে উচু আওয়াজে কথা বলে নিজের শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে চায়। এটা একেবারেই অসামাজিক। লোকমান হাকিমের ভাষায় উঁচু আওয়াজে কথা বলায় যদি কৃতিত্ব থাকত তাহলে এ ময়দানে গাধা হত সবচেয়ে সফল। কারণ গাধার আওয়াজেই সবচেয়ে উচু। তিনি পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছেন। কারো অমুসলিম পিতা-মাতা যদি ওই ব্যক্তিকে অমুসলিম বানানোর জন্য চাপ দেয় তারপরও তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না। দুনিয়াতে ভালো আচরণ দ্বারা তাদেরকে খুশি রাখতে হবে।

হাদিসেও লোকমান হাকিমের প্রজ্ঞাপূর্ণ বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। যেমন আবু মুসা আশআরি (রা.) এর সূত্রে রাসূল (সা.) থেকে তার একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বর্ণিত হয়েছে। লোকমান তার ছেলেকে বলেন, ‘হে বৎস! ভিক্ষা থেকে তুমি দূরে থেকো। কেননা তা রাতের বেলায় ভয়ের কারণ আর দিনে লাঞ্ছনা।’ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন ‘জ্ঞান মিসকিনকে বাদশাদের বৈঠকে বসার ব্যবস্থা করে।’ লোকমান হাকিম আমাদের থেকে বিদায় নেয়ার হাজার হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তার আদর্শ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা থেকে এখনো মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তার জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই, একদিন আমি সম্পদ ছেড়ে যাব বা আমাকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু জ্ঞান ও আদর্শ কখনো আমার থেকে বিলিন হবে না। মানুষের মনে চিরঞ্জীব করে রাখবে। যুগের পর যুগ আমার দ্বারা মানুষ উপকার পাবে। তাই সম্পদ নয় বরং জ্ঞানের পাহাড় গড়ো!

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top