পা ধুয়া পানি পান করেও প্রাণে রক্ষা পায়নি মীর জাফর!

S M Ashraful Azom
0
পা ধুয়া পানি পান করেও প্রাণে রক্ষা পায়নি মীর জাফর!
মীর জাফরের বংশধরেরা
সেবা ডেস্ক: ব্রিটিশরা তখন হাতের পুতুলের মতো মীর জাফরকে নাচাচ্ছিলো। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করে মাত্র পাঁচ বছর নবাবি করার সুযোগ পান মীর জাফর। অতঃপর শুরু হয় তার জরাজীর্ণ জীবন... ১৭ জানুয়ারি, ১৭৬৫ সালে ৭৪ বছর বয়সে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন মীর জাফর আলী খান। ভেঙে পড়ে তার পুরো শরীর। শরীরে তখন অসংখ্য ঘা ও ফোঁড়া। দূষিত রক্ত ও পুঁজ পড়ে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়।

এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাকে জঙ্গলে রেখে আসে। তখন মহারাজ নন্দকুমার নামে এক কুচক্রী ব্রাহ্মণ তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি-ই মাত্র ১০/১২ হাজার টাকার বিনিময়ে ফরাসীদের চন্দননগর দূর্গ ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কুচক্রী ব্রাহ্মণের পরামর্শেই মীর জাফর এক হিন্দু দেবী কিরীটেশ্বরীর পা ধোয়া পানি ওষুধ হিসেবে সেবন করেন। এভাবে ঈমান বিসর্জন দিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

‘মীর জাফর’ এই নামটি বাংলার মানুষের কাছে এখন একটি গালিস্বরূপ। বেইমানের প্রতিশব্দ। কোনো বাঙালিই তার সন্তানের এই নাম রাখে না। যার সম্পূর্ণ নাম মীর জাফর আলী খান। তার জন্ম ১৬৯১ সালে। ইংরেজ প্রভাবিত বাংলার একজন নবাব তিনি। এই মীর জাফর ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। তার পিতার নাম আহমেদ নাজাফি। বাবা-মা র দ্বিতীয় সন্তান। পারস্য থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে তিনি বাংলায় আসেন ভাগ্যান্বেষণে।

মীর জাফর কেন বিশ্বাসঘাতক হলেন?

বাংলায় এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি শুরু করেন। ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে আলীবর্দী খানের হয়ে মীর জাফর নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেন আলীবর্দী খান। এরপরই মীর জাফরকে মসনবদার পদ প্রদান করেন নবাব আলীবর্দী। নিজের বোন শাহ খানুমকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। সেই সময় তার বেতন হয় ১০০ টাকা। এরপরে তিনি নবাবের সেনা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। নবাব আলীবর্দী খান তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার নবাব করায় ক্ষুব্ধ হন মীর জাফর।

মীর জাফর প্রধান সেনাপতি হয়ে কখনোই সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি তিনি কপট আনুগত্য দেখাতেন। সবসময় তিনি চেয়েছেন বাংলার নবাবের পতন। বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ এর সঙ্গে তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। পলাশীর যুদ্ধে মূলত তার কারণেই ব্রিটিশদের হাতে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। এই ষড়যন্ত্রে ইয়ার লতিফ, জগত শেঠ, রায় দুর্লভ, উঁমিচাদ প্রমুখ সামিল ছিল।

এই যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডি‘য়া কোম্পানি মীরজাফরকে নবাবের মসনদে অধিষ্ঠিত করে। ক্ষমতার লোভে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা যেমন সত্যি। তেমনি অনেকের মতে মীর জাফরের মত জৈষ্ঠ্য, অভিজ্ঞ লোক থাকতে বালক অনভিজ্ঞ সিরাজউদ্দৌলাকে নবাব করে ভুল করেছিলেন আলীবর্দী খান। দীর্ঘদিন যুদ্ধ লড়ে একজন বালকের শাসন মানতে পারেননি মীর জাফর।

পলাশীর যুদ্ধেও বেইমানি করে মীর জাফর

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ৫৩ হাজার সৈন্যসামন্ত ও বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ নিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে ইংরেজদের ছিল মাত্র ৩ হাজার সৈন্য।  তবে কুচক্রী ষড়যন্ত্রকারী মীর জাফরের নির্দেশে কামান থেকে কোনো গুলিই সেদিন বের হয়নি। নিম্ন পদস্থ কয়েকজন কর্মচারী এবং কিছু সৈন্য ছাড়া কেউই যুদ্ধ করেনি। অবশেষে ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে কারাগারে প্রেরণ করে। পালিত ভাই মোহাম্মাদী বেগের হাতেই সিরাজউদ্দৌলার নির্মম মৃত্যু হয়। সিরাজের হত্যার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে সিংহাসনে বসায়। তবে তা ছিল তাদের অধীনস্থ কর্মচারীর মতো।

মীর জাফরের নবাবী

১৭৫৭ সালের ২৪ জুন, মীর জাফর নবাবী গ্রহণ করেন। বাস্তবিক অর্থে তিনি ছিলেন ইংরেজদের আজ্ঞাবহ হাতের পুতুল। ইতিহাসে তাকে বলা হয় ‘ক্লাইভের গাধা’। তিন বছরের নবাবি শাসনের পর ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে ১৭৬০ সালে তাকে সিংহাসনচ্যুত করে তারই জামাতা মীর কাশেমকে নবাব করা হয়। পরবর্তীতে জামাতা মীর কাশেমের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করে ইংরেজরা। দাঁত নখ বিহীন পঙ্গু বাঘের মতো মীর জাফর ইংরেজদের হাতের পুতুল রূপেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। মীর জাফরের সর্বমোট রাজত্বকাল ছিল পাঁচ বছর (১৭৫৭-১৭৬০ এবং ১৭৬৩-১৭৬৫)।

মীর জাফরের বর্তমান বংশধর

মীর জাফর প্রদত্ত বংশতালিকা অনুসারে তারা ছিলেন ইরাকের নাজাফ শহরের সৈয়দ। শেষের দিকে তার বংশধররা ‘মীর’ উপাধি ধারণ করা বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বৈশিষ্ট্যসূচক ‘মির্জা’ উপাধি ধারণ করতে থাকে। গুঞ্জন রয়েছে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন মীর জাফরের বংশেরই লোক। তবে পলাশীর ট্রাজেডির আড়াই শত বছর পরে এসে তার উত্তরসূরীদের সে বিষয়ে মূল্যায়ন ও আত্মোপলব্ধি কী বিষয়টি জানার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে নাকি মীর জাফরের বংশধরেরা বসবাস করেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তারা স্বীকারই করতে চাননি যে তারা মীর জাফরের বংশধর। পলাশীর যুদ্ধের আড়াইশ বছর পরেও বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানি বংশপরম্পরায় এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। হীনমন্যতায়, লজ্জায় নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে বেঁচে আছেন। 

বাংলায় মীর জাফরের উত্তরসূরীদের সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতের মুর্শিদাবাদে। মীর জাফরের অষ্টম বংশধর জাফর আলম মির্জা বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। তিনি অস্বীকার করলেও প্রতিবেশীরা জানান তিনি মীর জাফরের উত্তরসূরীদের একজন। জাফর আলম মির্জার বাল্যবন্ধু মুর্শিদাবাদের কবি সলিল ঘোষ নিশ্চিত করেন তিনি মীর জাফরের বংশধর। আগে তারা মীর জাফরের মূল প্রাসাদের পাশেই এক ভবনে বসবাস করতেন। দর্শনার্থীদের বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে পরবর্তীতে তারা অন্যত্র চলে যান। 

বেইমানির এই ইতিহাস সংরক্ষণে ভারতের মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের প্রাসাদের মূল তোরণের নামকরণ করা হয়েছে ‘নেমক হারাম দেউল’ বা বিশ্বাসঘাতক গেট হিসেবে। আর ইতিহাসের বিকৃতি না ঘটলে ‘নেমক হারাম’ হিসেবেই এই পুতুল নবাবের কথা স্মরণ করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top